অন্যান্য টপিকনবীদের জীবনী

উহুদের যুদ্ধ পার্ট ১৮

রাসূল (সাঃ)-এর জীবনে কঠিন সময়

  • উমারাহ (রাঃ) পতিত হওয়ার পর রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর সাথে মাত্র দু’ জন কুরাইশী সাহাবী রয়ে গিয়েছিলেন। যেমন সহীহুল বুখারী ও সহীহুল মুসলিমে আবূ উসমান (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, যে যুগে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) যুদ্ধ করেছেন ঐ যুদ্ধগুলোর কোন একটিতে তাঁর সাথে ত্বালহাহ ইবনু উবাইদুল্লাহ (রাঃ) এবং সা‘দ ইবনু আবূ ওয়াক্কাস (রাঃ) ছাড়া আর কেউই ছিল না। আর এ মুহূর্তটি রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর জন্যে অত্যন্ত ভয়ংকর ছিল এবং মুশরিকদের জন্যে ছিল সুবর্ণ সুযোগের মুহূর্ত। প্রকৃত ব্যাপার হল, মুশরিকরা এ সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে বিন্দুমাত্র ত্রুটি করে নি। তারা একাদিক্রমে রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর উপর আক্রমণ চালিয়েছিল এবং তাঁকে দুনিয়ার বুক হতে চিরতরে বিদায় করতে চেয়েছিল। এ আক্রমণেই ‘উতবাহ ইবনু আবূ ওয়াক্কাস তাঁকে পাথর মেরেছিল যার ফলে তিনি পার্শ্বদেশের ভরে পড়ে গিয়েছিলেন এবং তাঁর ডানদিকের রুবাঈ দাঁত ভেঙ্গে গিয়েছিল।

আর তাঁর নীচের ঠোঁটটি আহত হয়েছিল। আব্দুল্লাহ ইবনু শিহাব যুহরী অগ্রসর হয়ে তাঁর ললাট আহত করে। আব্দুল্লাহ ইবনু ক্বায়িমাহ নামক আর একজন দুর্ধর্ষ ঘোড়সওয়ার লাফিয়ে গিয়ে তাঁর কাঁধের উপর এতো জোরে তরবারীর আঘাত করে যে, তিনি এক মাসেরও বেশী সময় পর্যন্ত ওর ব্যথা ও কষ্ট অনুভব করতে থাকেন। তবে তাঁর লৌহবর্ম কাটতে পারে নি। এরপর সে আর একবার তাঁকে তরবারীর আঘাত করে, যা তাঁর চক্ষুর নীচের হাড়ের উপর লাগে এবং এর কারণে শিরস্ত্রাণের দুটি কড়া চেহারার মধ্যে ঢুকে যায়।[3] সাথে সাথে সে বলে ওঠো, ‘এটা লও! আমি ক্বামিয়া’র (টুকরোকারীর) পুত্র।’ রাসূলুল্লাহ (সাঃ) চেহারা হতে রক্ত মুছতে মুছতে বলেন, ‘আল্লাহ তোকে টুকরো টুকরো করে ফেলুন।

সহীহুল বুখারীতে বর্ণিত হয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর রুবাঈ দাঁত ভেঙ্গে দেয়া হয় এবং মাথা আহত করা হয়। ঐ সময় তিনি মুখমন্ডল হতে রক্ত মুছে ফেলছিলেন এবং মুখে উচ্চারণ করছিলেন,

ঐ কওম কিরূপে কৃতকার্য হতে পারে যারা তাদের নাবী (সাঃ)-এর মুখমন্ডল আহত করেছে এবং তাঁর দাঁত ভেঙ্গে দিয়েছে, অথচ তিনি তাদেরকে আল্লাহর দিকে আহবান করছিলেন?’

ঐ সময় আল্লাহ তা‘আলা নিম্নের আয়াত অবতীর্ণ করেন,

আল্লাহ তাদের প্রতি ক্ষমাশীল হবেন অথবা তাদেরকে শাস্তি প্রদান করবেন- এ ব্যাপারে তোমার কিছু করার নেই। কেননা তারা হচ্ছে যালিম।’।

ত্বাবারানীর বর্ণনায় রয়েছে যে, ঐ দিন রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছিলেন, ‏‏

ঐ কওমের উপর আল্লাহর কঠিন শাস্তি হোক যারা তাদের নাবী (সাঃ)-এর চেহারাকে রক্তাক্ত করেছে। তারপর কিছুক্ষণ থেমে বললেন, ‏ অর্থাৎ ‘হে আল্লাহ! আমার কওমকে ক্ষমা করুন, তারা জানে না।’

সহীহুল মুসলিমের হাদীসেও এটাই আছে যে, তিনি বার বার বলছিলেন,

অর্থাৎ ‘হে আমার প্রতিপালক! আমার কওমকে ক্ষমা করে দিন, তারা জানে না।’

কাযী আইয়াযের ‘শিফা’ গ্রন্থে নিম্নলিখিত শব্দ রয়েছে, ‏(

অর্থাৎ ‘হে আল্লাহ! আমার কওমকে হিদায়াত দান করুন, নিশ্চয় তারা জানে না।’

এতে কোন সন্দেহ নেই যে, মুশরিকরা রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে দুনিয়া হতে বিদায় করে দিতে চেয়েছিল। কিন্তু দ’জন কুরাইশী সাহাবী অর্থাৎ সা‘দ ইবনু আবূ ওয়াক্কাস (রাঃ) ও ত্বালহাহ ইবনু উবাইদুল্লাহ (রাঃ) অসাধারণ বীরত্ব ও অতুলনীয় বাহাদুরীর সাথে কাজ করে শুধু দু’জনই মুশরিকদের সফলতা অসম্ভব করে দেন। এ দু’ব্যক্তি আরবের সুদক্ষ তীরন্দায ছিলেন। তাঁরা তীর মেরে মেরে আক্রমণকারী মুশরিকদেরকে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) হতে দূরে সরিয়ে রাখেন।

রাসূলুল্লাহ (সাঃ) সা‘দ ইবনু আবী ওয়াক্কাস (রাঃ)-এর জন্যে স্বীয় তূণ হতে সমস্ত তীর বের করে ছড়িয়ে দেন এবং তাঁকে বলেন, ‘তীর ছুঁড়তে থাক, তোমার উপর আমার পিতামাতা উৎসর্গ হোন।’

সা‘দ (রাঃ)-এর সৌজন্য ও কর্মদক্ষতা এর দ্বারাই অনুমান করা যেতে পারে যে, তিনি ছাড়া আর কারো জন্যে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তাঁর পিতামাতা উৎসর্গিত হওয়ার কথা বলেন নি।

ত্বালহাহ (রাঃ)-এর কর্মদক্ষতা অনুমান করা যেতে পারে সুনানে নাসায়ীর একটি বর্ণনার মাধ্যমে, যাতে জাবির (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর উপর মুশরিকদের ঐ সময়ের আক্রমণের উল্লেখ করেছেন যখন তিনি মুষ্টিমেয় আনসারদের সাথে রয়ে গিয়েছিলেন।

জাবির (রাঃ) বলেন যে, মুশরিকরা রাসুলুল্লাহ (সাঃ)-এর নিকটবর্তী হয়ে গেলে তিনি বলেন,

‏‏‘এদের সাথে মোকাবালা করে এমন কেউ আছ কি?’

উত্তরে ত্বালহাহ (রাঃ) বলেন, ‘আমি আছি।’ এরপর জাবির (রাঃ) আনসারদের অগ্রসর হওয়া এবং একে একে শহীদ হওয়ার কথা বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করেছেন যা সহীহুল মুসলিমের উদ্ধৃতি দিয়ে বর্ণনা করেছি। জাবির (রাঃ) বলেন যে, যখন তাঁরা শহীদ হয়ে যান তখন ত্বালহাহ (রাঃ) সম্মুখে অগ্রসর হন এবং এগারো জন লোকের সমান একাই যুদ্ধ করেন। শেষ পর্যন্ত তাঁর হাতের উপর তরবারীর এমন এক আঘাত লাগে যে, এর ফলে তার হাতের আঙ্গুলিগুলো কেটে যায়। ঐ সময় তার মুখ দিয়ে ‘হিস’ শব্দ বের হয়। তখন রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন,

তুমি যদি বিসমিল্লাহ বলতে তবে তোমাকে ফিরিশতা উঠিয়ে নিতেন এবং জনগণ দেখতে পেত।’

জাবির (রাঃ) বলেন যে, অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা মুশরিকদেরকে ফিরিয়ে দেন। ইকলীলে হা’কিমের বর্ণনা রয়েছে যে, উহুদের দিন তাঁকে ৩৯টি বা ৩৫টি আঘাত লেগেছিল এবং তাঁর শাহাদত ও মধ্যমা আঙ্গুলিদ্বয় অকেজো হয়ে গিয়েছিল।

ইমাম বুখারী (রহ.) ক্বায়স ইবনু আবী হাযিম (রাঃ) হতে বর্ণনা করেছেন যে, তিনি বলেন, ‘আমি ত্বালহাহ (রাঃ)-এর হাত দেখেছি যে, ওটা নিষ্ক্রিয় ছিল। ঐ হাত দ্বারাই তিনি উহুদ যুদ্ধের দিন নাবী (সাঃ)-কে রক্ষা করেছিলেন।’

ইমাম তিরমিযীর (রহ.) বর্ণনায় রয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) ঐ দিন ত্বালহাহ (রাঃ)-এর ব্যাপারে বলেছিলেন,

কেউ যদি ভূ-পৃষ্ঠে কোন শহীদকে চলতে ফিরতে দেখত চায় তবে সে যেন ত্বালহাহ ইবনু উবাইদুল্লাহ (রাঃ)-কে দেখে নেয়।

আবূ দাঊদ তায়ালিসী (রাঃ) ‘আয়িশাহ (রাঃ) হতে বর্ণনা করেছেন যে, আবূ বাকর (রাঃ) যখন উহুদ যুদ্ধের আলোচনা করতেন তখন বলতেন, ‘এ যুদ্ধ সম্পূর্ণটাই ত্বালহাহ (রাঃ)-এর জন্যে ছিল (অর্থাৎ এ যুদ্ধে রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে হিফাযাত করার আসল কাজ তিনিই আনজাম দিয়েছিলেন)। আবূ বাকর (রাঃ) তাঁর ব্যাপারে নিম্নের কথাও বলেন,

অর্থাৎ ‘হে ত্বালহাহ ইবনু উবাইদুল্লাহ (রাঃ), তোমার জন্যে জান্নাত ওয়াজিব হয়ে গেছে এবং তুমি তোমার এখানে আয়তলোচনা হুরদের ঠিকানা বানিয়ে নিয়েছ।’

এ সংকটময় মুহূর্তে আল্লাহ তা‘আলা অদৃশ্য হতে স্বীয় সাহায্য নাযিল করেন। যেমন সহীহুল বুখারী ও সহীহুল মুসলিমে সা‘দ (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, তিনি বলেন, ‘আমি উহুদের যুদ্ধের দিন রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে দেখেছি, তাঁরা তাঁর পক্ষ হতে বীর বিক্রমে যুদ্ধ করছিলেন। আমি এর পূর্বে এবং পরে এ দু’জন লোককে আর কখনো দেখিনি।’ অন্য এক বর্ণনায় রয়েছে যে, তারা দু’জন ছিলেন জিব্রাঈল (আঃ) ও মীকাঈল (আঃ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button