উহুদের যুদ্ধ পার্ট ২০
মুশরিকদের চাপ বৃদ্ধি
-
এদিকে মুশরিকদের সংখ্যাও ক্রমে ক্রমে বৃদ্ধি পাচ্ছিল। এর ফলে তাদের আক্রমণও কঠিন হতে কঠিনতর আকার ধারণ করছিল যার ফলে শক্তি এবং চাপ বৃদ্ধি পাচ্ছিল। এমনকি রাসূলুল্লাহ (সাঃ) ঐ কতগুলো গর্তের মধ্যে একটি গর্তে পড়ে যান যেগুলো আবূ আ’মির ফা’সিক এ প্রকারের অনিষ্টের জন্যেই খনন করে রেখেছিল। এর ফলে রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর হাঁটু মুবারক মচকে যায়। আলী (রাঃ) তাঁর হাত ধরে নেন এবং ত্বালহাহ ইবনু উবাইদুল্লাহ (রাঃ) (যিনি নিজেও চরমভাবে আহত হয়েছিলেন) তাঁকে স্বীয় বক্ষে নিয়ে নেন। এরপর তিনি সোজা হয়ে দাঁড়াতে সক্ষম হন।
না’ফে ইবনু জুবায়ের (রাঃ) বলেন যে, তিনি একজন মুহাজির সাহাবীকে বলতে শুনেছেন, ‘আমি উহুদের যুদ্ধে হাযির ছিলাম। আমি দেখি যে, চতুর্দিক হতে রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর উপর তীর বর্ষিত হচ্ছে, আর তিনি তীরগুলোর মাঝেই রয়েছেন। কিন্তু সমস্ত তীরই ফিরিয়ে দেয়া হচ্ছে (অর্থাৎ তাঁকে বেষ্টনকারী সাহাবীগণ ওগুলো রুখে নিচ্ছেন) আমি আরো দেখি যে, আব্দুল্লাহ ইবনু শিহাব যুহরী বলতেছিল, ‘মুহাম্মাদ (সাঃ) কোথায় আছে তা আমাকে বলে দাও। এখন হয় আমি থাকব না হয় সে থাকবে।’ অথচ রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তাঁর বাহুতেই ছিলেন (অর্থাৎ তার অতি নিকটে ছিলেন) এবং তাঁর সাথে আর কেউ ছিল না। অতঃপর সে তাঁকে ছেড়ে সামনে এগিয়ে যায়। এ দেখে সাফওয়ান তাকে ভৎর্সনা করে। জবাবে সে বলে, আল্লাহর কসম! আমি তাঁকে দেখতেই পাই নি। আল্লাহর শপথ! আমার নিকট হতে তাঁকে রক্ষা করা হয়েছে। এরপর আমরা চারজন লোক তাঁকে হত্যা করার প্রতিক্ষা করে বের হই। কিন্তু তাঁর কাছে পৌঁছতে পারি নি।
অসাধারণ বীরত্ব ও প্রাণপণ লড়াই
-
যাহোক এ সময় মুসলিমরা এমনভাবে বীরত্বের সাথে ও জীবন বাজী রেখে যুদ্ধ করেছেন এবং আত্মত্যাগের পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করেছেন যার দৃষ্টান্ত ইতিহাসে মিলে না। যেমন আবূ ত্বালহাহ (রাঃ) নিজেকে রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর সামনে ঢাল স্বরূপ বানিয়ে নিয়েছেন। তিনি স্বীয় বক্ষ উপরে উঠিয়ে নিতেন, যাতে রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে শত্রুদের তীর হতে রক্ষা করতে পারেন। আনাস (রাঃ) বর্ণনা করেছেন যে, উহুদের দিন লোকেরা (অর্থাৎ সাধারণ মুসলিমরা পরাজয় বরণ করে রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর নিকট আসার পরিবর্তে এদিক ওদিক পালিয়ে যায়, আর আবূ ত্বালহাহ একটি ঢাল নিয়ে রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর সামনে দাঁড়িয়ে যান। তিনি একজন সুদক্ষ তীরন্দাজ ছিলেন। তিনি খুব টেনে তীর চালাতেন। ঐ দিন তিনি দু’টি কিংবা তিনটি ধনুক ভেঙ্গে ছিলেন।
রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর নিকট দিয়ে কোন লোক তূণ নিয়ে গমন করলে তিনি বলতেন,
‘তোমার তূণের তীরগুলো আবূ ত্বালহাহ (রাঃ)-এর জন্য ছড়িয়ে দাও।’
আর তিনি যখন এক একবার মাথা উঠিয়ে যুদ্ধের অবস্থা দেখতেন তখন আবূ ত্বালহাহ (রাঃ) চমকিত হয়ে বলতেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল (সাঃ)! আমার পিতামাতা আপনার প্রাণের বিনিময়ে উৎসর্গিত হোক। আমার দেহ আপনার দেহের ঢাল হোক। মাথা বের করবেন না।’[1] এ সময় আবূ ত্বালহাহ (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর প্রতি নিক্ষিপ্ত তীরগুলো নিজের বুক পেতে গ্রহণ করছিলেন।
আনাস (রাঃ) থেকে এটাও বর্ণিত আছে যে, আবূ ত্বালহাহ নাবী (সাঃ) সহ একই ঢালের মধ্যে আত্মরক্ষা করছিলেন। আবূ ত্বালহাহ ছিলেন খুব দক্ষ তীরন্দাজ। যখন তিনি তীর নিক্ষেপ করতেন তখন নাবী কারীম (সাঃ) গর্দান উঠিয়ে দেখতেন যে, তীরটি কোথায় নিক্ষিপ্ত হচ্ছে।[2]
আবূ দুজানাহ (রাঃ)-এর বীরত্বের কথা পূর্বেই উল্লেখিত হয়েছে। এ বিপদের মুহূর্তে তিনি রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর সামনে এসে দাঁড়ালেন এবং নিজের পিঠকে করলেন ঢাল। ওর উপর তীর নিক্ষিপ্ত হচ্ছিল অথচ তিনি ছিলেন অনড়। ওয়াক্কাস
হাতিব ইবনু বালতাআহ (রাঃ) ‘উতবাহ ইবনু আবী ওয়াক্কাসের পিছনে ধাওয়া করেন যে নাবী কারীম (সাঃ)-এর দস্ত মুবারক শহীদ করেছিল। তাকে তিনি ভীষণ জোরে তরবারীর আঘাত করেন। এর ফলে তার মস্তক দেহচ্যুত হয়ে যায়। তারপর তিনি তার ঘোড়া ও তরবারী অধিকার করে নেন। সা‘দ ইবনু আবী ওয়াক্কাস (রাঃ) তাঁর নিজের ঐ ভাই ‘উতবাহকে নিজ হাতে হত্যা করার জন্য খুবই আকাঙ্ক্ষী ছিলেন। কিন্তু এতে তিনি সফলকাম হননি। বরং এ সৌভাগ্য হাতিব (রাঃ) লাভ করেন।
সাহল ইবনু হুনায়েফ (রাঃ) একজন সুদক্ষ তীরন্দায ছিলেন। তিনি রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর নিকট মৃত্যুর দীক্ষা গ্রহণ করেছিলেন। তিনি অত্যন্ত বীরত্বের সাথে মুশরিকদের আক্রমণ প্রতিরোধ করেন।
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) নিজেও তীর চালাচ্ছিলেন। যেমন কাতাদাহ ইবনু নু’মান (রাঃ) বর্ণনা করেছেন, ‘রাসূলুল্লাহ (সাঃ) স্বীয় ধনুক দ্বারা এতো তীর চালিয়েছিলেন যে, ওর প্রান্ত ভেঙ্গে গিয়েছিল।’ অতঃপর ঐ ধনুকটি কাতাদাহ ইবনু নু’মান (রাঃ) নিয়ে নেন এবং ওটা তার কাছেই থাকে। ঐ দিন এ ঘটনাও সংঘটিত হয় যে, কাতাদা (রাঃ)-এর একটি চোখে চোট লেগে ওটা তাঁর চেহারার উপর ঝুলে পড়ে। তখন রাসূলুল্লাহ (সাঃ) নিজ হাতে ওটাকে ওর নিজ স্থানে ঢুকিয়ে দেন। এরপর তাঁর ঐ চক্ষুটিকেই খুব সুন্দর দেখাত এবং ওটারই দৃষ্টি শক্তিও বেশী তীক্ষ্ণ হয়েছিল।
আব্দুর রহমান ইবনু আউফ (রাঃ) যুদ্ধ করতে করতে মুখে আঘাত প্রাপ্ত হন, ফলে তার সামনের দাঁত ভেঙ্গে যায় এবং তাঁর দেহে বিশটি কিংবা তার চেয়েও বেশী যখম হন। তাঁর পা যখম হয়, ফলে তিনি খোঁড়া হয়ে যান।
আবূ সাঈদ খুদরী’র (রাঃ) পিতা মালিক বিন সানান (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর গন্ডদেশের রক্ত চুষে নিলেন আর তিনি সুস্থ হয়ে উঠলেন। তারপর তিনি (সাঃ) বললেন, থুথু ফেলে দাও। তিনি বললেন, আল্লাহর শপথ আমি থুথু ফেলব না। তারপর তিনি ফিরে গেলেন ও লড়াইয়ে যোগ দিলেন। তারপর নাবী (সাঃ) বললেন, ‘যে ব্যক্তি জান্নাতি কোন ব্যক্তিকে দেখতে চায় সে যেন একে দেখে। তারপর তিনি শহীদ হয়ে গেলেন।
এ যুদ্ধে উম্মু ‘উমারাহ নুসাইবাহ বিনতু কা’ব (রাঃ) নাম্নী এক অসাধারণ মহিলাও অসীম বীরত্ব ও আত্মত্যাগের পরিচয় প্রদান করেন। তিনি ‘আয়িশাহ (রাঃ) ও অন্যান্য মুসলিম মহিলাদের সঙ্গে শুশ্রূষা কারিণীরূপে সমরক্ষেত্রে উপস্থিত হয়ে আহত সৈনিকদের পানি সরবরাহ এবং তাদের অন্যান্য প্রকার সেবা শুশ্রূষা করছিলেন। এমন সময় তিনি শুনতে পেলেন যে, মুসলিমরা পরাজিত হয়েছেন এবং কুরাইশ সৈন্য রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে আক্রমণ করতে শুরু করেছে। এ সংবাদ শ্রবণ মাত্র উম্মু আম্মারাহ (রাঃ) কাঁধের মশক ও হাতের জলপাত্র ছুঁড়ে ফেলেন। ঐ সময় মুষ্টিমেয় ভক্ত প্রাণপণ করে রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর দেহ রক্ষা করছিলেন। উম্মু আম্মারাহ (রাঃ) সিংহীর ন্যায় বিক্রম সহকারে সেখানে উপস্থিত হলেন এবং বিশেষ ক্ষিপ্রতা ও নৈপুণ্য সহকারে তীর বর্ষণ করে কুরাইশদেরকে ধ্বংস করতে লাগলেন। এক সময় তিনি ইবনু ক্বামিয়ার সামনে পড়ে গেলেন। ইবনু ক্বামিয়ার তার কাঁধের উপর এত জোরে তরবারীর আঘাত করল যে, এর ফলে তার কাঁধ গভীরভাবে যখম হল। তিনিও তার তরবারী দ্বারা ইবনু কামআরকে কয়েকবার আঘাত করলেন। কিন্তু নরাধম দুটি লৌহবর্ম পরিহিত ছিল বলে বেঁচে গেল। শত্রুদের বর্শা ও তরবারীর আঘাতে তার সারা দেহ ক্ষতবিক্ষত ও জর্জরিত হয়ে পড়ল। কিন্তু এ বীরাঙ্গনা সে দিকে ভ্রুক্ষেপ না করে নিজের কর্তব্য পালন করে যেতে লাগলেন। উহুদ যুদ্ধের বর্ণনা কালে স্বয়ং রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, ‘ঐ বিপদের সময় আমি দক্ষিণে বামে যে দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করি, সে দিকেই দেখি যে, উম্মু আম্মারাহ (রাঃ) আমাকে রক্ষা করার জন্য যুদ্ধ করছেন।’
উহুদের যুদ্ধে মুসলিমগণের জাতীয় পতাকা মুস’আব ইবনু উমায়ের (রাঃ)-এর হাতে অর্পিত হয়েছিল। এ পতাকার মর্যাদা রক্ষার জন্য মুসআব (রাঃ)-কে প্রথম থেকেই যুদ্ধ করে আসতে হয়েছিল এবং তীর ও তরবারীর আঘাতে তার আপাদমস্তক একেবারে জর্জরিত হয়ে গিয়েছিল। আলোচ্য বিপদের সময় দুর্ধর্ষ ইবনু কামআহ অগ্রসর হয়ে তাঁর দক্ষিণ বাহুর উপর তরবারীর আঘাত করল। বাহুটি কেটে যাওয়ার সাথে সাথে মুসআব (রাঃ) বাম হাতে পতাকা ধারণ করলেন। কিন্তু অবিলম্বে ইবনু কামআর তরবারীর দ্বিতীয় আঘাতে তাঁর বাম বাহুটিও দেহচ্যুত হয়ে পড়ল। সঙ্গে সঙ্গে শত্রুপক্ষের একটি তীর এসে তার জ্ঞান, ভক্তি ও বীরত্বপূর্ণ বক্ষটিভেদ করে চলে গেল এবং তিনি চির নিদ্রায় নিদ্রিত হয়ে শহীদের অমর জীবন লাভ করলেন। নাবী (সাঃ)-এর আকৃতির সাথে মুসআব (রাঃ)-এর আকৃতির সাদৃশ্য ছিল। সুতরাং মুসআব (রাঃ)-কে শহীদ করে ইবনু কামআর মুশরিকদের দিকে ফিরে গেল এবং চিৎকার করে করে ঘোষণা করল যে, মুহাম্মাদ (সাঃ)-কে হত্যা করা হয়েছে।