অন্যান্য টপিককোরআননবীদের জীবনী

উহুদের যুদ্ধ পার্ট ৬

আব্দুল্লাহ ইবনু উবাই ও তার সঙ্গীদের শঠতা

ফজর হওয়ার কিছু পূর্বে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) পুনরায় চলতে শুরু করলেন এবং ‘শাওত’ নামক স্থানে পৌঁছে ফজরের সালাত আদায় করলেন। এখন তিনি শত্রুদের নিকটে ছিলেন এবং উভয় সেনাবাহিনী একে অপরকে দেখতে ছিল। এখানে মুনাফিক্ব আব্দুল্লাহ ইবনু উবাই বিদ্রোহী হয়ে ওঠে। সে এক তৃতীয়াংশ সৈন্য (তিনশ জন সৈন্য) নিয়ে এ কথা বলতে বলতে ফিরে গেল যে, অযথা কেন জীবন দিতে যাব? সে এ বিতর্কও উত্থাপন করল যে, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তার কথা না মেনে অন্যদের কথা মেনে নিয়েছেন।

রাসূলুল্লাহ (সাঃ) যে তার কথা মেনে নেন নি এটা তার মুসলিম বাহিনী হতে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ার অবশ্যই কারণ ছিল না। কেননা এ অবস্থায় নাবী (সাঃ)-এর সেনাবাহিনীর সাথে এত দূর পর্যন্ত তার আসার কোন প্রশ্নই উঠত না। বরং সেনাবাহিনীর যাত্রা শুরু হওয়ার পূর্বেই তার পৃথক হয়ে যাওয়া উচিত ছিল। সুতরাং প্রকৃত ব্যাপার তা নয় যা সে প্রকাশ করেছিল। বরং প্রকৃত ব্যাপার ছিল, ঐ সংকটময় মুহূর্তে পৃথক হয়ে গিয়ে মুসলিম বাহিনীর মধ্যে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করা যখন শত্রুরা তাদের প্রতিটি কাজ কর্ম লক্ষ্য করছিল। তখন মুসলিম বাহিনীর মধ্যে একটি অস্বস্তিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করাই ছিল তার মূখ্য উদ্দেশ্য। যাতে একদিকে সাধারণ সৈন্যরা রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর সঙ্গ ত্যাগ করে এবং যারা বাকী থাকবে তাদেরও উদ্যম ও মনোবল ভেঙ্গে পড়ে, পক্ষান্তরে এ দৃশ্য দেখে শত্রুদের সাহস বেড়ে যায়। সুতরাং তার এ ব্যবস্থাপনা ছিল নাবী কারীম (সাঃ) এবং তার সঙ্গীদেরকে শেষ করে দেয়ারই এক অপকৌশল। মূলত ঐ মুনাফিক্বের এ আশা ছিল যে, শেষ পর্যন্ত তার ও তার বন্ধুদের নেতৃত্বের জন্য ময়দান সাফ হয়ে যাবে।

এ মুনাফিক্বের কোন কোন উদ্দেশ্য সফল হবারও উপক্রম হয়েছিল। কেননা আরো দুটি দলের অর্থাৎ আউস গোত্রের মধ্যে বনু হারিসাহ এবং খাযরাজ গোত্রের মধ্যে বনু সালামাহরও পদস্খলন ঘটতে যাচ্ছিল এবং তারা ফিরে যাবার চিন্তা ভাবনা করছিল। কিন্তু আল্লাহ তা‘আলা তাদের সহায়তা করেন। ফলে তাঁদের চিত্তচাঞ্চল্য দূর হয়ে যায় এবং তারা ফিরে যাবার সংকল্প ত্যাগ করে।

তাদের সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন:

,যখন তোমাদের মধ্যকার দু’দল ভীরুতা প্রকাশ করতে মনস্থ করেছিল, কিন্তু আল্লাহ উভয়ের বন্ধু ছিলেন, মু’মিনদের উচিত আল্লাহর উপর ভরসা করা।’ [আল ‘ইমরান (৩) : ১২২]

যাহোক, মুনাফিক্বরা ফিরে যাবার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলে ঐ সংকটময় সময়ে জাবির (রাঃ)-এর পিতা আব্দুল্লাহ ইবনু হারাম (রাঃ) তাদেরকে তাদের দায়িত্ব ও কর্তব্যের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়ার ইচ্ছা করেন। সুতরাং তিনি তাদেরকে ধমকের সুরে (যুদ্ধের জন্যে) ফিরে আসার উৎসাহ প্রদান করে তাদের পিছনে পিছনে চলতে লাগলেন এবং বলতে থাকলেন, ‘এসো, আল্লাহর পথে যুদ্ধ কর অথবা প্রতিরোধ কর।’ কিন্তু তারা উত্তরে বলল, ‘আমরা যদি জানতাম যে, তোমরা যুদ্ধ করবে তবে আমরা ফিরে যেতাম না।’ এ উত্তর শুনে আব্দুল্লাহ ইবনু হারাম (রাঃ) এ কথা বলতে বলতে ফিরে আসলেন, ‘ওরে আল্লাহর শত্রুরা, তোদের উপর আল্লাহর গযব নাযিল হোক। মনে রেখ যে, আল্লাহ তা‘আলা স্বীয় নাবী (সাঃ)-কে তোদের হতে বেপরোয়া করবেন।’ এ সব মুনাফিক্বের সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

আর মুনাফিক্বদেরকেও জেনে নেয়া। তাদেরকে বলা হয়েছিল; এসো, ‘আল্লাহর পথে যুদ্ধ কর, কিংবা (কমপক্ষে) নিজেদের প্রতিরক্ষার ব্যবস্থা কর’। তখন তারা বলল, ‘যদি আমরা জানতাম যুদ্ধ হবে, তাহলে অবশ্যই তোমাদের অনুসরণ করতাম’। তারা ঐ দিন ঈমানের চেয়ে কুফরীরই নিকটতম ছিল, তারা মুখে এমন কথা বলে যা তাদের অন্তরে নেই, যা কিছু তারা গোপন করে আল্লাহ তা বিশেষরূপে জ্ঞাত আছেন।’ [আল ‘ইমরান (৩) : ১৬৭]

উহুদ প্রান্তে অবশিষ্ট ইসলামী সেনাবাহিনী

মুনাফিক্বদের এ শঠতা ও প্রত্যাবর্তনের পর রাসূলুল্লাহ (সাঃ) অবশিষ্ট সাতশ জন সৈন্য নিয়ে শত্রুবাহিনীর দিকে ধাবিত হলেন। শত্রুদের শিবির তাঁর মাঝে ও উহুদের মাঝে কয়েক দিক থেকে বাধা সৃষ্টি করছিল। তাই, তিনি প্রশ্ন করলেন, ‘শত্রুদের পাশ দিয়ে গমন ছাড়াই ভিন্ন কোন পথ দিয়ে আমাদেরকে নিয়ে যেতে পারে এমন কেউ আছে কি?’ এ প্রশ্নের জবাবে আবূ খাইসামা (রাঃ) আরয করলেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল (সাঃ)! এ খিদমতের জন্যে আমি হাযির আছি।’’ অতঃপর তিনি এক সংক্ষিপ্ত পথ অবলম্বন করলেন, যা মুশরিকদের সেনাবাহিনীকে পশ্চিম দিকে ছেড়ে দিয়ে বনু হারিসা গোত্রের শস্য ক্ষেত্রের মধ্য দিয়ে চলে গিয়েছিল।

এ পথ ধরে যাবার সময় তাদেরকে মিরবা’ ইবনু ক্বাইযীর বাগানের মধ্য দিয়ে যেতে হয়। এ লোকটি মুনাফিক্ব ছিল এবং  অন্ধও ছিল। সে সেনাবাহিনীর আগমন অনুধাবন করে মুসলিমগণের মুখমন্ডলে ধূলো নিক্ষেপ করল এবং বলতে লাগল, ‘আপনি যদি আল্লাহর রাসূল (সাঃ) হন তবে জেনে রাখুন যে, আমার বাগানে আপনার প্রবেশের অনুমতি নেই।’’

তার এ কথা শোনা মাত্র মুসলিমরা তাকে হত্যা করতে উদ্যত হল। কিন্তু রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তাদেরকে বললেন

তাকে হত্যা করো না, সে অন্তর ও চোখের অন্ধ।’’

তারপর নাবী কারীম (সাঃ) সম্মুখে অগ্রসর হয়ে উপত্যকার শেষ মাথায় অবস্থিত উহুদ পাহাড়ের ঘাটিতে অবতরণ করেন এবং সেখানে মুসলিম বাহিনীর শিবির স্থাপন করিয়ে নেন। সামনে ছিল মদীনা ও পিছনে হল সুউচ্চ উহুদ পর্বত। এভাবে শত্রুদের বাহিনী মুসলিম ও মদীনার মাঝে পৃথককারী সীমানা হয়ে গেল।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button