একজন আদর্শ মা ও তার সন্তান
যখন থেকে আমরা কিছুটা বুঝতে আরম্ভ করেছি তখন থেকেই দেখি আম্মা নামায পড়েন।
দুআ-মুনাজাত করেন।
দুআতে খুব কান্নাকাটি করেন।
আমরা তো রাতে আম্মাজানের সাথেই ঘুমাতাম।
শুয়ে শুয়েই আম্মাজান আমাদের সূরা কাহফের তাফসীর শিখিয়েছেন।
এখনও তা মনে আছে।
আম্মাজান আমাকে শুনিয়েছেন সূরা বুরূজের ঘটনা- যালিম রাজা তার প্রজাদেরকে কেবল আল্লাহর প্রতি ঈমান আনার ‘অপরাধে’ পুড়ে পুড়ে মেরেছে।
যা এখনও আমার মনে আছে।
বাজার থেকে কোনোকিছু আনা হলে আম্মাজান বলতেন, তোমরা ভাইবোনেরা নিজেরা ভাগ করে নাও।
তিনি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে খেয়াল করতেন- কে লোভী আর কে উদার।
তারপর তিনি আমাদের শুধরে দিতেন। আমাদের এক প্রতিবেশী খালা ছিলেন। আমরা তাকে মরিয়ম খালা বলে ডাকতাম।
আল্লাহ তাআলা তার মাগফিরাত করুন। তিনি খুবই পরহেযগার ছিলেন।
বড় উঁচু মাপের আল্লাহর ওলী ছিলেন। বলা যায়, আল্লাহর সাথে তার দোস্তীর সম্পর্ক ছিল।
বুখারী শরীফ, মুসলিম শরীফ, মেশকাত শরীফ ইত্যাদি হাদীসের বড় বড় কিতাব তার পড়া ছিল।
তিনি আমাদের খুবই আদর করতেন। আমি তো তার কোলে-কাঁখে বড় হয়েছি। একবার আমার মুখ ফসকে একটি কথা বের হয়ে যায়।
বলি, এ বাড়ির মালিক এ ব্যাপারে বলছে যে,…।
আাম্মাজান কথাটা শুনে ফেললেন। আমার উপর ভীষণ রেগে যান।
বলেন, মালিক! বাড়ির মালিক!
জায়গার মালিক!!!
গোটা দুনিয়ার মালিক তো একমাত্র আল্লাহ।
যা, এ ঘরে তোর ভাত নেই।
ছুটে গেলাম মরিয়ম খালার কাছে।
খালা, আম্মাজান তো আমার উপর খুব রেগে গেছেন।
আমার খাবার বন্ধ করে দিয়েছেন।
খালা এসে আম্মাজানের কাছে সুপারিশ করলেন।
বললেন, কথাটা ও অন্য হিসেবে বলেছে। সমস্যা নেই।
তারপর আম্মাজান আমাকে খেতে দেন।
আমার যখন পড়ার বয়স হল, আম্মাজান বললেন, আমি একে দ্বীন শেখাব।
বড় ভাই তখন জাগতিক শিক্ষা অর্জন করছিলেন।
তাই আম্মাজানের খুব শখ ছিল আমাকে দ্বীন শেখাবেন।
সবাই বোঝাল-দেখ, ছেলেকে ইংরেজী শিক্ষায় শিক্ষিত কর।
ভালো একটা রুজীর ব্যবস্থা হবে।
নতুবা শুধু দ্বীন শিখে খাবে কী? আম্মাজান সাফ জানিয়ে দিলেন, ছেলে যদি বাস্তবেই দ্বীন শেখে দেখবে দুনিয়া তার পিছে পিছে কীভাবে গড়াতে থাকে! আমি তো ছোট ছিলাম।
তত একটা বুঝতাম না।
আম্মাজানের পাশে বসে কথাগুলো শুনতাম আর চিন্তা করতাম, মাঠে খেলার সময় তো বল গড়াতে দেখি।
বুঝতেই পারছেন, আমার বুঝের কী হালত ছিল!
তো আম্মাজানের কথায় সবাই আশাহত হত।
এরপর আম্মাজান আমাকে এক উস্তাযের নিকট পাঠালেন।
উস্তাদজী আমাকে খুব দিল দিয়ে পড়াতেন।
সন্তানের মেযাজ ও তবিয়ত তৈরীতে মায়ের তরবিয়তের বিকল্প নেই।
যাতে পড়াও হয় আবার যেহেনও তৈয়ার হয়।
এজন্য আম্মাজান অভিনব কৌশল অবলম্বন করতেন।
আমার মন জুগিয়ে বলতেন, বাবা, আজকে আমরা হযরত ইউসুফ আঃ এর গল্প শুনব।
তুমি কিতাব থেকে পড়ে শোনাও তো! বাবা, আজ হযরত মূসা আঃ এর গল্প শোনাও তো!
হযরত ঈসা আঃ এর গল্প শোনাও তো! আমার যেহেন বানানোর জন্য তিনি এমনটি করতেন।
বাচ্চা ছিলাম।
কখনো মোড়ামুড়ি করতাম।
গড়িমসি করে চলে যেতাম।
আম্মাজান আবার সোহাগ করে ডেকে এনে পড়াতেন।
ঐ যামানায় একটি মোমবাতিও ছিল অনেক দামি জিনিস।
যেহেতু এটা জ্বলে গলে শেষ হয়ে যায় তাই একে ব্যয়বহুল মনে করা হত।
সুতরাং মোমবাতির পরিবর্তে ব্যবহার হত কুপিবাতি।
এক রাতে কুপির আলোতে আম্মাজানকে ঘটনা পড়ে শোনাচ্ছিলাম।
আসলে আল্লাহর সাথে যার সম্পর্ক থাকে সে মুখ ফুটে কিছু বলে ফেললে আল্লাহ তা অপূর্ণ রাখেন না।
আমার এখনও কথাটা স্পষ্ট মনে আছে। আম্মাজান হঠাৎ বলে উঠলেন, বাবা, আজ এ অন্ধকার ঘরে তুমি পড়ছ আর আমি একা বসে বসে শুনছি।
আল্লাহ পাক তোমার উপর এমন একদিন আনবেন যখন লক্ষ লক্ষ লোক তোমার বয়ান শোনার জন্য বসে থাকবে।
আমি অনেক চেষ্টা করি যে, নিজের কথা বলব না।
কিন্তু আম্মাজানের কথা না বলে যে পারি না।
যখন কুরআনে কারীম পড়তে শিখেছি। আম্মাজান আমাদের দিয়ে তিলাওয়াত শুনতেন।
আমরাও শোনাতাম।
আয়াতে যখন জাহান্নামের প্রসঙ্গ আসত তিনি জারজার হয়ে কাঁদতে থাকতেন। জান্নাতের আলোচনা আসলে তার চেহারায় আনন্দের আভা ফুটে উঠতো। তখন তো বুঝতাম না।
এখন বুঝে আসে তার হাসি-কান্নার রহস্য। কুরআনে কারীমের অষ্টম পাড়ায় জান্নাত-জাহান্নামের আলোচনা আছে।
প্রায়ই তিনি আমাদের বলতেন, বাবা, অষ্টমপাড়াটা শোনাও।
কখনও কখনও আমরা জাহান্নামের আয়াত রেখে তিলাওয়াত করলে আম্মাজান বলতেন, বাবা, এখানে তো জান্নাতের সাথে জাহান্নামের কথাও আছে। ঐটা শোনাও না কেন?
এ ছিল তার আন্দায!
আম্মাজান আমাকে যে উস্তাযের নিকট পাঠিয়েছিলেন তিনি আমাকে খুব দিল দিয়েই পড়াচ্ছিলেন।
কিন্তু উস্তাযে মুহতারামকে এখান থেকে পিত্রালয় ইউপিতে পাড়ি জমাতে হল। যাবার সময় তিনি বললেন, এ খোকাকেও আমার সাথে রওয়ানা করে দিন। ছয়মাসের মধ্যে আমি তাকে এই পরিমাণ শিখিয়ে দিব, যাতে হিন্দুস্তানের বড় মাদরাসায় সে ভর্তি হতে পারে। আম্মাজানও প্রস্তুত হয়ে গেলেন।
ঐ আমলে আমাদের পরিবারে এত টানাপড়েন ছিল যে, ইউপি পর্যন্ত পৌঁছতে আনুষঙ্গিক খরচসহ প্রয়োজন ছিল পঞ্চাশ রুপি।
কিন্তু এ মামুলী অঙ্ক আম্মাজানের হাতে ছিল না।
কোত্থেকে ধার-কর্য করে পঞ্চাশ রুপি জোগাড় করলেন।
আমি ইউপি গেলাম।
ছয় মাসে বড় মাদরাসায় ভর্তি হওয়ার উপযুক্ত হয় গেলাম। ভর্তিও হলাম।
বার মাস তাতে থাকলাম।
কিন্তু সরাসরি আমার নেগরানী করার মত সেখানে কেউ ছিল না।
আমি আমার মত করেই চলতাম।
আমার শওক ও জযবার কোনো নেগরানী ও নিয়ন্ত্রণ না থাকায় দৈনিক বাইশ ঘণ্টা পড়তাম। আর দু’ঘণ্টা ঘুমাতাম।
এতে আমার শরীর খুব ভেঙ্গে পড়ে। মারাত্মক ব্যাধি দেখা দেয়।
দৃষ্টিশক্তিও ভীষণ প্রভাবিত হয়।
তবুও আমি তেমন গ্রাহ্য করিনি।
এ অবস্থায় আম্মাজান আমাকে বোম্বাই ডেকে পাঠান।
আমাকে দেখে তো তিনি কাঁদতে কাঁদতে শেষ।
হায়, তুমি তো আমার আশা-ভরসা সব মাটি করে দিলে!
স্বাস্থ্যের খেয়াল রাখলে না!
এই স্বাস্থ্য নিয়ে এখন পড়বে কীভাবে? নিয়ে গেলেন ডাক্তারের কাছে।
তারা আমাকে দেখে বললেন, সন্তানের আশা ছেড়ে দিন।
সান্ত্বনা স্বরূপ ওষুধ খাওয়াতে থাকুন।
তার ডিবি তৃতীয় স্তরে পৌঁছেছে। আম্মাজানকে বললাম, মরতেই যখন হবে তাহলে আর ঘরে থেকে লাভ কী? আল্লাহর রাস্তায় গিয়েই মরি!
আম্মাজান এ কথা শুনে আরো কাঁদলেন।
যাহোক, বোম্বাইতে থেকেই আবার পড়াশুনা শুরু করলাম।
মেশকাত পর্যন্ত এখানেই থাকলাম।
এরই মাঝে তাবলীগে চারমাস সময়ও লাগানো হল।
বিয়ে শাদী হল। সন্তান-সন্ততিও হল। শিক্ষাজীবনের শেষ বর্ষ দাওরায়ে হাদীস পড়ার সময় হল।
এদিকে আম্মাজানও খুব দুর্বল হয়ে পড়েন।
দৃষ্টিশক্তি রহিত হয়ে যায়।
দাঁতগুলো অকেজো হয়ে পড়ে।
চলতে পারেন না।
এ অবস্থাতেও তিনি আমাকে হাজার-দেড় হাজার মাইল দূরে পাঠালেন, বড় মাদরাসায় পড়ার জন্য।
যাবার সময় মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন- বাবা, যাও, আল্লাহ ভরসা!
বোম্বাই থেকে আমি চলে আসার পর আম্মাজানের অবস্থার আরো অবনতি ঘটে।
আত্মীয়-স্বজন সবাই চলে আসে। বোনেরাও দূর-দূরান্ত থেকে চলে আসে। যখন একেবারে মুমূর্ষু অবস্থা, সবাই বলল, আম্মাজান যদি বলেন, তাহলে আপনার ছেলেকে তার-মারফত ডেকে আনি? আম্মাজান বললেন, না না, তাকে ডেকো না। অন্য যাকে খুশি ডাক।
আমি মরে যাওয়ার পর আল্লাহ তাআলা যখন জিজ্ঞাসা করবেন, কী এনেছিস?
বলব, আয় আল্লাহ! আমি তো খালি হাতেই এসেছি।
কিন্তু আমার একটা ছেলেকে আপনার রাস্তায় রেখে এসেছি।
এ ওসিলায় যদি আমাকে নাজাত দেন!
এরপর আম্মাজান যখন একেবারেই নিস্তেজ হয়ে পড়লেন সবাই মিলে তাকে গোসল করিয়ে বিছানায় শোয়াল। আম্মাজান বললেন, সবদিক থেকে ঘ্রাণ আসছে যে!
অথচ তখন তার এ অবস্থা যে, সুগন্ধ-দুর্গন্ধ কিছুই বোঝেন না।
তারপর বললেন, ‘আসসালামু আলাইকুম ওয়ারাহমাতুল্লাহ’।
একটুখানি মুচকি হাসলেন।
আবার বেহুঁশ হয়ে গেলেন।
কিছুক্ষণ পর হুঁশ ফিরে এলে মেয়েরা জিজ্ঞাসা করল, আম্মাজান, আপনি কাকেই বা সালাম বললেন আর কেনই বা হাসলেন?
বললেন, দেড় হাজার মাইল দূরে থাকা ছেলেটিকে আমি দুই ফেরেশতার মাঝে দেখতে পেলাম।
তাই ফেরেশতাদের সালাম বললাম আর ছেলেকে কাছে পেয়ে হাসলাম।
অথচ অন্যান্য ভাই-বোনেরা তখন আশেপাশেই ছিল।
কিন্তু দৃষ্টি না থাকার দরুণ তিনি কাউকেই দেখতে পাচ্ছিলেন না।
কিছুক্ষণ পর তিনি একেবারেই নিস্তেজ হয়ে পড়েন।
আর কোনো সারা-শব্দ নেই।
বছরের মাঝামাঝি সময়ে আম্মাজানের ইন্তেকাল হয়।
খবর আমার কাছে পৌঁছেছিল।
আমি সেখানে থেকেই ঈছালে সওয়াব করে দেই।
তারপর বছর শেষ করে বাড়িতে আসি।
[] বোনেরা আমার! তোমাদের নিকট আমার দরখাস্ত- ঘরোয়া তালীমের ব্যবস্থা জোরদার কর।
নামাযের খুব এহতেমাম করো।
দুরূদ শরীফ, যিকির, তিলাওয়াত, তাসবীহ, এস্তেগফার-এগুলোর প্রতি যত্নবান হও।
বাচ্চাদের তরবিয়তের ব্যাপারে বিশেষভাবে খেয়াল রাখ।
শরীয়ত অনুযায়ী তাদের প্রতিপালন কর।