জামাতে নামাজের ফযিলত-
-
রমজান মাসে দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত নামাজে রোজাদার মুসল্লিরা মসজিদে সমবেত বা একত্র হন। যখন মুয়াজ্জিন সুমধুর ধ্বনিতে আজান দিতে থাকেন, তখন রোজাদাররা সব কাজকর্ম স্থগিত রেখে দূরদূরান্ত থেকে নামাজের সময় মসজিদ অভিমুখে যাত্রা করেন এবং সব মুসল্লি একত্র হয়ে জামাতে নামাজ আদায় করেন। এভাবে রোজাদার মুসল্লিরা মসজিদে নামাজ পড়তে এলে তাঁদের পরস্পরের মধ্যে ঐক্য ও ভ্রাতৃত্ববোধ গড়ে ওঠে। মসজিদে জামাতে নামাজ আদায়ের অশেষ সওয়াব সম্পর্কে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, জামাতে নামাজ পড়ার ফজিলত একা পড়ার চেয়ে ২৭ গুণ ঊর্ধ্বে। (বুখারি ও মুসলিম) তিনি আরও বলেছেন, একজন লোক ঘরে নামাজ পড়লে একটি নেকি পান, তিনি ওয়াক্তিয়া মসজিদে পড়লে ২৫ গুণ, জুমা মসজিদে পড়লে ৫০০ গুণ, মসজিদে আকসায় পড়লে ৫০ হাজার গুণ, আমার মসজিদে অর্থাৎ মসজিদে নববীতে পড়লে ৫০ হাজার গুণ এবং মসজিদুল হারাম বা কাবার ঘরে পড়লে এক লাখ গুণ সওয়াব পাবেন। (ইবনে মাজা, মিশকাত)
মাহে রমজানে মসজিদে নামাজ আদায়ে শুধু যে রোজাদার বান্দার আত্মিক উন্নতি হয় তা-ই নয়; সামাজিক ক্ষেত্রেও এর গুরুত্ব অপরিসীম। জামাতে নামাজ আদায় করায় রোজাদার মুসলমানরা দৈনিক পাঁচবার একত্রে মিলিত হওয়ার সুযোগ পান। ফলে তাদের মধ্যে সম্প্রীতি গড়ে ওঠে। এভাবে একতাবদ্ধ হয়ে সৎ কাজ করার শিক্ষা জামাতে নামাজ আদায়ের মাধ্যমে অর্জন করা যায়। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘নামাজের প্রথম সারি হলো ফেরেশতাদের সারির মতো। তোমরা যদি প্রথম সারির মর্যাদা সম্পর্কে জানতে, তবে তা পাওয়ার জন্য ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়তে। মনে রেখো, একা নামাজ পড়ার চেয়ে দুই ব্যক্তির একত্রে নামাজ পড়া উত্তম। আর দুই ব্যক্তির একত্রে নামাজ পড়ার চেয়ে তিন ব্যক্তির একত্রে নামাজ পড়া উত্তম। এভাবে যত বেশি লোকের জামাত হবে, তা আল্লাহর কাছে তত বেশি প্রিয় হবে।’
মসজিদে দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের আগে সবাই অজু করে পাক-পবিত্র হয় এবং নামাজের মধ্যে ওঠা-বসার মাধ্যমে শারীরিক পরিশ্রম হয়ে থাকে। এতে মুসল্লিদের দেহ সতেজ ও সবল হয় এবং মন প্রফুল্ল থাকে। কোনো কাজ করতে গেলে অলসতা আসে না। ফলে নামাজি ব্যক্তি উপার্জনক্ষম হয়। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে আছে, যে ব্যক্তি উত্তমভাবে পবিত্রতা অর্জন করে জামাতে নামাজ পড়ার জন্য কোনো একটি মসজিদের দিকে পা বাড়াবেন, তাঁর প্রতিটি কদমে আল্লাহ তাঁর জন্য একটি করে পুণ্য লিখে দেবেন। তাঁর একটি করে মর্যাদা বাড়িয়ে দেবেন এবং একটি করে পাপ মুছে দেবেন। -
একবার এক অন্ধ ব্যক্তি রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে এসে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘হে আল্লাহর রাসুল! আমার এমন কেউ নেই, যে আমাকে হাত ধরে মসজিদে আনবে।’ অতঃপর লোকটি মসজিদে উপস্থিত হওয়া থেকে অব্যাহতি চান এবং ঘরে নামাজ পড়ার অনুমতি চান। রাসুলুল্লাহ তাঁকে ঘরে নামাজ পড়ার অনুমতি দিয়ে দেন। লোকটি রওনা করলে রাসুলুল্লাহ তাঁকে পুনরায় ডেকে পাঠান। লোকটি ফিরে আসেন। রাসুলুল্লাহ তাঁকে জিজ্ঞাসা করেন, ‘তুমি কি আজান শুনতে পাও?’ লোকটি বললেন, ‘হ্যাঁ, শুনতে পাই।’ রাসুলুল্লাহ বললেন, ‘তাহলে তুমি মসজিদে উপস্থিত হবে।’ বললেন, ‘ফজর ও এশার নামাজ মুনাফিকদের জন্য অন্যান্য নামাজের তুলনায় অধিকতর ভারী। তোমরা যদি জানতে এ দুটি নামাজের মধ্যে কী পরিমাণ সওয়াব নিহিত আছে, তবে হামাগুড়ি দিয়ে হলেও নামাজে উপস্থিত হতে।’ অন্য হাদিসে বর্ণিত আছে, ‘এশা ও ফজরের নামাজ মুনাফিকদের জন্য অত্যন্ত কষ্টসাধ্য। যদি তাদের জানা থাকত যে এই জামাতের সওয়াব কত বেশি, তাহলে জমিনে হেঁচড়িয়ে হলেও এসে তারা শরিক হতো। (তারগিব)
জামাতে নামাজ আদায়ের জন্য মসজিদে প্রবেশ ও বাইর হওয়ার সময় মুসল্লিদের দোয়া শিক্ষা দিয়ে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যখন তোমাদের কেউ মসজিদে ঢুকবে, তখন এই দোয়া পড়বে, “আল্লাহুম্মাফ তাহলি আবওয়াবা রাহমাতিকা” অর্থাৎ “হে আল্লাহ! তুমি আমার জন্য তোমার রহমতের দরজাগুলো খুলে দাও”। যখন বের হবে, তখন এই দোয়া পড়বে, “আল্লাহুম্মা ইন্নি আসআলুকা মিন ফাদলিকা”। অর্থাৎ “হে আল্লাহ! আমি তোমার কাছে তোমার অনুগ্রহ প্রার্থনা করছি”।’ (মুসলিম, মিশকাত) মসজিদে প্রবেশের সময় নবী করিম (সা.) প্রথমে ডান পা রাখতেন। (তাবারানি) আর মসজিদ থেকে বের হওয়ার সময় প্রথমে বাঁ পা বের করতেন। (হাকেম) -
মসজিদে যাওয়ার ও প্রবেশের পর করণীয় সম্পর্কে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, যে ব্যক্তি নিজের ঘর থেকে অজু করে ফরজ নামাজ পড়ার উদ্দেশ্যে মসজিদের দিকে যান, তিনি একজন ইহরামওয়ালা হজ সমাধাকারীর নেকি পান। (আহমাদ, আবু দাউদ, মিশকাত) ‘যখন তোমরা কেউ মসজিদে ঢুকবে, তখন বসার আগে দুই রাকাত নামাজ পড়ে নেবে।’ (বুখারি ও মুসলিম) ‘যখন তোমরা জান্নাতের বাগানে ঘোরাফেরা করবে, তখন কিছু ফলমূল খেয়ে নিয়ো।’ সাহাবিরা বললেন, ‘জান্নাতের বাগান কোনটা?’ তিনি বললেন: ‘মসজিদগুলো।’ তাঁরা বললেন, ‘এর ফল খাওয়া কেমন?’ তিনি বললেন, ‘এই তাসবিহগুলো পড়া, সুবহানাল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ, ওয়া লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু আল্লাহু আকবার।’ (তিরমিজি)
রোজাদার মুসলমান ভাইয়েরা যখন সদলবলে জামাতে নামাজ আদায় করতে মসজিদে যান অথবা কেউ ইতিকাফে বসেন, তখন ওই ইবাদতের দৃশ্যটা দেখতে কতই না সুন্দর লাগে! দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত নামাজে, সাপ্তাহিক জুমার নামাজে, মাহে রমজানে তারাবি ও কদরের নামাজে এবং দুই ঈদের নামাজের জামাতে যখন সব মুসল্লি সমবেত হন, তখন পারস্পরিক খোঁজখবর নিতে পারেন এবং তাঁদের মধ্যে ভাবের আদান-প্রদান হয়। সে জন্য রোজাদাররা জামাতে নামাজ আদায়ের জন্য মসজিদে সমবেত হয়ে নিয়ম-শৃঙ্খলা, সময়ানুবর্তিতা, সামাজিক ভ্রাতৃত্ববোধ, পারস্পরিক হৃদ্যতা ও সম্প্রীতি গড়ে তুলতে পারেন। এভাবে রোজাদার নামাজি ব্যক্তিরা সমাজে ধনী-গরিব একে অন্যের খোঁজখবর নিয়ে পরস্পরের সুখ-দুঃখের সম–অংশীদার হতে পারেন।