মক্কার বাইরে ইসলামের দাওয়াত পর্ব ২
এর পর আদাস যখন তাদের নিকট ফিরে গেল তখন ভ্রাতৃদ্বয় তাকে বলল, ‘বলত দেখি ব্যাপারটি কী? ঐ ভদ্রলোক দেখছি তোমাকেও বিগড়িয়ে দিল।’
সে বলল, ‘হে আমার মনিব! এ ধরাধামে তাঁর চেয়ে উত্তম মানুষ আর কেউই নেই। তিনি আমাকে এমন এক কথা বলেছেন যা নাবী রাসূল ছাড়া অন্য কেউই জানে না।’
তারা দুজন বলল, ‘দেখ আদ্দাস, ঐ ব্যক্তি যেন তোমাকে তোমার ধর্ম থেকে ফিরিয়ে না দেয়। কারণ তোমার ধর্ম তার ধর্ম থেকে উত্তম।’
কিছুক্ষণ অবস্থানের পর রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বাগান থেকে বের হয়ে মক্কার পথে যাত্রা করেন। তার মিশনের বিফলতাজনিত চিন্তা ও দৈহিক যন্ত্রনার দাপটে হৃদয় মন ছিল অত্যন্ত ভারাক্রান্ত ও বিশ্রান্ত। এমন অবস্থার মধ্য দিয়ে তিনি যখন ‘কারনে মানাযেল’ নামক স্থানে পৌঁছলেন, তখন আল্লাহ রাববুল আলামীনের আদেশে জিবরাঈল (আঃ) সেখানে আগমন করেন। তাঁর সঙ্গে ছিলেন পর্বত নিয়ন্ত্রণকারী ফেরেশতামন্ডলী। আল্লাহর তরফ থেকে তাঁরা এ অভিপ্রায় নিয়ে এসেছিলেন যে, নাবী (সাঃ) যদি ইচ্ছা করেন তা হলে তারা দু’পাহাড়কে একত্রিত করে দূরাচার মক্কাবাসীকে পিশে মারবেন।
এ ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ বুখারী শরীফে আয়িশাহ সিদ্দীকাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত হয়েছে। তিনি বর্ণনা করেছেন যে, রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে তিনি একদিন জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আপনার জীবনে কি এমন কোনদিন এসেছে যা উহুদের দিন চাইতেও কঠিন ছিল?
তিনি উত্তরে বললেন, ‘হ্যাঁ’’, তোমার সম্প্রদায়ের নিকট থেকে আমাকে যে যে দুঃখ কষ্টের সম্মুখীন হতে হয়েছে তার মধ্যে সব চাইতে কঠিন ছিল ঐ দিনটি যে দিন আমি ঘাঁটিতে বিচলিত ছিলাম, যখন আমি নিজেকে আবদে ইয়ালাইল বিন আবদে কুলালের পুত্রদের নিকট পেশ করেছিলাম। কিন্তু তারা আমার কথায় কর্ণপাত না করায় দুশ্চিন্তা ও ব্যথায় পরিশ্রান্ত হয়ে আমি নিজ পথে গমন করি। এভাবে চলতে চলতে ‘কারনে সায়ালেবে’ যখন এসে পৌঁছি তখন আমার চেতনা ফিরে আসে।
এ সময় আমার মনে কিছুটা স্বস্তিবোধের সৃষ্টি হয়। সেখানে আমি আকাশের দিকে চোখ তুলে তাকাতেই দেখি যে, একখন্ড মেঘ আমাকে ছায়া দান করছে; ব্যাপারটি আরও ভালভাবে নিরীক্ষণ করলে বুঝতে পারি যে, এতে জিবরাঈল (আঃ) রয়েছেন। তিনি আমাকে আহবান জানিয়ে বলেন, ‘আপনার সম্প্রদায় আপনাকে যা বলেছে এবং আপনার প্রতি যে আচরণ করেছে আল্লাহ তা‘আলা সব কিছুই শুনেছেন এবং দেখেছেন। এখন তিনি পর্বত নিয়ন্ত্রণকারী ফিরিশতাগণকে আপনার খেদমতে প্রেরণ করেছেন। আপনি তাঁদের কে যা ইচ্ছা নির্দেশ প্রদান করুন। এরপর পর্বতের ফিরিশতা আমাকে সালাম জানিয়ে বললেন, ‘হে মুহাম্মাদ (সাঃ)! কথা এটাই, আপনি যদি চান যে এদেরকে আমি দু’পাহাড় একত্রিত করে পিষে মারি তাহলে তাই হবে।[3] নাবী কারীম (সাঃ) বললেন, ‘না, বরং আমার আশা, মহান আল্লাহ এদের পৃষ্ঠদেশ হতে এমন বংশধর সৃষ্টি করবেন যারা একমাত্র তাঁর ইবাদত করবে এবং অন্য কাউকেও তাঁর অংশীদার ভাববে না।[4]
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এ উত্তরে তাঁর অসাধারণ মানবত্ব প্রেমে সমুজ্জ্বল এক ব্যক্তিত্ব এবং ক্ষমাশীল অনুপম চরিত্রের পরিচয় পাওয়া যায়। সাত আসমানের উপর হতে আগত এই গায়েবী মদদের প্রস্তাব ও প্রতিশ্রুতি নিয়ে ফিরিশতাগণ যখন তাঁর খেদমতে উপস্থিত হন তখন তাঁর ব্যক্তিত্ব এবং চরিত্র যেন আরও মহিমান্বিত হয়ে ওঠে। নিজের দুঃখ কষ্ট ভুলে গিয়ে তিনি সুস্থির চিত্তে আল্লাহ তা‘আলার দরবারে শুকরিয়া আদায় করতে থাকেন। এভাবে তাঁর মানসাকাশ থেকে চিন্তা ভাবনার মেঘ দূরীভূত হয়ে যায়।
তারপর তিনি মক্কা অভিমুখে অগ্রসর হওয়ার পথে ওয়াদীয়ে নাখলায় অবস্থান করেন। এখানে দুটো জায়গা বসবাসের উপযোগী ছিল। তন্মধ্যে একটি হচ্ছে আসসাইলুল কবীর এবং দ্বিতীয়টি হচ্ছে যায়মা। কেননা, সেখানে পানি ছিল কিছুটা সহজলভ্য এবং জায়গা দুটো ছিল শস্য শ্যামল। কিন্তু তিনি (সাঃ) এ দুটো জায়গার মধ্যে কোথায় অবস্থান করেছিলেন কোন সূত্র থেকেই তার সন্ধান পাওয়া যায় নি।
ওয়াদী নাখলায় তিনি যখন কয়েক দিনের জন্য অবস্থান করেছিলেন সে সময় আল্লাহ তা‘আলা তাঁর নিকট জিনদের একটি দলকে প্রেরণ করেন যার উল্লেখ কুরআন মাজীদের দুটো জায়গায় এসেছে। এর মধ্যে একটি হচ্ছে সূরাহ আল-আহক্বাফে এবং অন্যটি সূরাহ জিনে। সূরাহ আহক্বাফের আয়াতগুলো হচ্ছে,
{وَإِذْ صَرَفْنَا إِلَيْكَ نَفَرًا مِّنَ الْجِنِّ يَسْتَمِعُوْنَ الْقُرْآنَ فَلَمَّا حَضَرُوْهُ قَالُوْا أَنصِتُوْا فَلَمَّا قُضِيَ وَلَّوْا إِلٰى قَوْمِهِم مُّنذِرِيْنَ قَالُوْا يَا قَوْمَنَا إِنَّا سَمِعْنَا كِتَابًا أُنزِلَ مِن بَعْدِ مُوْسٰى مُصَدِّقًا لِّمَا بَيْنَ يَدَيْهِ يَهْدِيْإِلَى الْحَقِّ وَإِلٰى طَرِيْقٍ مُّسْتَقِيْمٍ يَا قَوْمَنَا أَجِيْبُوْا دَاعِيَ اللهِ وَآمِنُوْا بِهِ يَغْفِرْ لَكُم مِّن ذُنُوْبِكُمْ وَيُجِرْكُم مِّنْ عَذَابٍ أَلِيْمٍ} [الأحقاف:29: 31]
স্মরণ কর, যখন জিন্নদের একটি দলকে তোমার প্রতি ফিরিয়ে দিয়েছিলাম যারা কুরআন শুনছিল। তারা যখন সে স্থানে উপস্থিত হল, তখন তারা পরস্পরে বলল- চুপ করে শুন। পড়া যখন শেষ হল তখন তারা তাদের সম্প্রদায়ের কাছে ফিরে গেল সতর্ককারীরূপে। ৩০. (ফিরে গিয়ে) তারা বলল- হে আমাদের সম্প্রদায়! আমরা একটি কিতাব (এর পাঠ) শুনেছি যা মূসার পরে অবতীর্ণ হয়েছে, তা পূর্বেকার কিতাবগুলোর সত্যতা প্রতিপন্ন করে, সত্যের দিকে আর সঠিক পথের দিকে পরিচালিত করে। ৩১. হে আমাদের সম্প্রদায়! আল্লাহর দিকে আহবানকারীর প্রতি সাড়া দাও এবং তার প্রতি ঈমান আন, আল্লাহ তোমাদের গুনাহ মাফ করে দেবেন আর তোমাদেরকে যন্ত্রণাদায়ক ‘আযাব থেকে রক্ষা করবেন।’ (আল-আহক্বাফ ৪৬ : ২৯-৩১)
قُلْ أُوْحِيَ إِلَيَّ أَنَّهُ اسْتَمَعَ نَفَرٌ مِنَ الْجِنِّ فَقَالُوْا إِنَّا سَمِعْنَا قُرْآناً عَجَباً (1) يَهْدِيْ إِلَى الرُّشْدِ فَآمَنَّا بِهِ وَلَنْ نُشْرِكَ بِرَبِّنَا أَحَداً (2) وَأَنَّهُ تَعَالٰى جَدُّ رَبِّنَا مَا اتَّخَذَ صَاحِبَةً وَلا وَلَداً (3) وَأَنَّهُ كَانَيَقُوْلُ سَفِيْهُنَا عَلَى اللهِ شَطَطاً (4) وَأَنَّا ظَنَنَّا أَنْ لَنْ تَقُوْلَ الْأِنْسُ وَالْجِنُّ عَلَى اللهِ كَذِباً (5) وَأَنَّهُ كَانَ رِجَالٌ مِنَ الْأِنْسِ يَعُوْذُوْنَ بِرِجَالٍ مِنَ الْجِنِّ فَزَادُوْهُمْ رَهَقاً (6) وَأَنَّهُمْ ظَنُّوْا كَمَا ظَنَنْتُمْ أَنْلَنْ يَبْعَثَ اللَّهُ أَحَداً (7) وَأَنَّا لَمَسْنَا السَّمَاءَ فَوَجَدْنَاهَا مُلِئَتْ حَرَساً شَدِيْداً وَشُهُباً (8) وَأَنَّا كُنَّا نَقْعُدُ مِنْهَا مَقَاعِدَ لِلسَّمْعِ فَمَنْ يَسْتَمِعِ الْآنَ يَجِدْ لَهُ شِهَاباً رَصَداً (9) وَأَنَّا لا نَدْرِيْ أَشَرٌّ أُرِيْدَبِمَنْ فِي الْأَرْضِ أَمْ أَرَادَ بِهِمْ رَبُّهُمْ رَشَداً (10) وَأَنَّا مِنَّا الصَّالِحُوْنَ وَمِنَّا دُوْنَ ذٰلِكَ كُنَّا طَرَائِقَ قِدَداً (11) وَأَنَّا ظَنَنَّا أَنْ لَنْ نُعْجِزَ اللهَ فِي الْأَرْضِ وَلَنْ نُعْجِزَهُ هَرَباً (12) وَأَنَّا لَمَّا سَمِعْنَا الْهُدَىآمَنَّا بِهِ فَمَنْ يُؤْمِنْ بِرَبِّهِ فَلا يَخَافُ بَخْساً وَلا رَهَقاً (13) وَأَنَّا مِنَّا الْمُسْلِمُوْنَ وَمِنَّا الْقَاسِطُوْنَ فَمَنْ أَسْلَمَ فَأُوْلَئِكَ تَحَرَّوْا رَشَداً (14) وَأَمَّا الْقَاسِطُوْنَ فَكَانُوْا لِجَهَنَّمَ حَطَباً (15) [ الجن: 1: 15].
১. বল, ‘আমার কাছে ওয়াহী করা হয়েছে যে, জিন্নদের একটি দল মনোযোগ দিয়ে (কুরআন) শুনেছে তারপর তারা বলেছে ‘আমরা এক অতি আশ্চর্যজনক কুরআন শুনেছি ২. যা সত্য-সঠিক পথ প্রদর্শন করে, যার কারণে আমরা তাতে ঈমান এনেছি, আমরা কক্ষনো কাউকে আমাদের প্রতিপালকের অংশীদার গণ্য করব না। ৩. আর আমাদের প্রতিপালকের মর্যাদা অতি উচ্চ, তিনি গ্রহণ করেননি কোন স্ত্রী আর কোন সন্তান। ৪. আর আমাদের মধ্যেকার নির্বোধেরা তাঁর সম্পর্কে সীমাতিরিক্ত কথাবার্তা বলত। ৫. আর আমরা ধারণা করতাম যে, মানুষ ও জ্বিন আল্লাহ সম্পর্কে কক্ষনো মিথ্যে কথা বলবে না। ৬. কতিপয় মানুষ কিছু জ্বিনের আশ্রয় নিত, এর দ্বারা তারা জ্বিনদের গর্ব অহঙ্কার বাড়িয়ে দিয়েছে। ৭. (জ্বিনেরা বলেছিল) তোমরা (জ্বিনেরা) যেমন ধারণা করতে তেমনি মানুষেরা ধারণা করত যে, (মৃত্যুর পর) আল্লাহ কাউকে পুনরুত্থিত করবেন না। ৮. আর আমরা আকাশের খবর নিতে চেয়েছিলাম কিন্তু আমরা সেটাকে পেলাম কঠোর প্রহরী বেষ্টিত ও জ্বলন্ত উল্কাপিন্ডে পরিপূর্ণ। ৯. আমরা (আগে) সংবাদ শুনার জন্য আকাশের বিভিন্ন ঘাঁটিতে বসতাম, কিন্তু এখন কেউ সংবাদ শুনতে চাইলে তার উপর নিক্ষেপের জন্য সে জ্বলন্ত অগ্নিকুন্ডকে লুকিয়ে থাকতে দেখে। ১০. আমরা জানি না (এই পরিবর্তিত অবস্থার মাধ্যমে) পৃথিবীবাসীর অকল্যাণই চাওয়া হচ্ছে, না তাদের প্রতিপালক তাদেরকে সরল সঠিক পথ দেখাতে চান। ১১. আর আমাদের কিছু সংখ্যক সৎকর্মশীল, আর কতিপয় এমন নয়, আমরা ছিলাম বিভিন্ন মত ও পথে বিভক্ত। ১২. আমরা বুঝতে পেরেছি যে, আমরা পৃথিবীতে আল্লাহকে পরাস্ত করতে পারব না, আর পালিয়েও তাঁকে অপারগ করতে পারব না। ১৩. আমরা যখন হিদায়াতের বাণী শুনতে পেলাম, তখন তার উপর ঈমান আনলাম। যে ব্যক্তি তার প্রতিপালকের উপর ঈমান আনে তার কোন ক্ষতি বা যুল্মের ভয় থাকবে না। ১৪. আমাদের মধ্যে কিছু সংখ্যক (আল্লাহর প্রতি) আত্মসমর্পণকারী আর কিছু সংখ্যক অন্যায়কারী। যারা আত্মসমর্পণ করে তারা সঠিক পথ বেছে নিয়েছে। ১৫. আর যারা অন্যায়কারী তারা জাহান্নামের ইন্ধন।’ (আল-জিন ৭২ : ১-১৫)