অন্যান্য টপিকনবীদের জীবনী

মক্কার বাইরে ইসলামের দাওয়াত পর্ব ৩

এ ঘটনা প্রসঙ্গে অবতীর্ণ এ আয়াতসমূহের প্রাসঙ্গিক আলোচনা থেকে বুঝা যায় যে, এ আয়াত অবতীর্ণ হওয়ার পূর্বে মহানাবী (সাঃ) জিনদের আগমনের কথা জানতেন না। আল্লাহ রাববুল আলামীন এ আয়াতের মাধ্যমে তাঁকে জিনদের আগমনের কথা অবহিত করেন এবং তখন তিনি তা জানতে পারেন। এ থেকে এও বুঝা যায় যে, রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর নিকট এটাই ছিল জিনদের প্রথম আগমন। বিভিন্ন হাদীস সূত্রে জানা যায় যে, এর পর থেকে নাবী কারীম (সাঃ)-এর দরবারে তাদের গমনাগমন চলতে থাকে।

জিনদের আগমন ও ইসলাম গ্রহণের ব্যাপারটি ছিল প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ তা‘আলার তরফ থেকে দ্বিতীয় সাহায্যমূলক ঘটনা যে সাহায্য তিনি করেছিলেন তাঁর অদৃশ্য ভান্ডার থেকে অদৃশ্য বাহিনী দ্বারা। এ ঘটনা সম্পর্কে আল্লাহ ছাড়া আর কারোরই অবগতি ছিল না। এ ঘটনার সঙ্গে সম্পর্কিত যে সকল আয়াত অবতীর্ণ হয়েছে তাতে নাবী কারীম (সাঃ)-এর দাওয়াতের কামিয়াবির সুসংবাদ রয়েছে। অধিকন্তু, এটাও পরিস্কার হয়ে গিয়েছে যে, বিশ্বের কোন শক্তি তাঁর দাওয়াতের কার্যকারিতার পথে কোন প্রকার প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে সক্ষম হবে না। অতএব ইরশাদ হয়েছে,

‏{‏وَمَن لَّا يُجِبْ دَاعِيَ اللهِ فَلَيْسَ بِمُعْجِزٍ فِي الأَرْضِ وَلَيْسَ لَهُ مِن دُوْنِهِ أَولِيَاء أُوْلَئِكَ فِي ضَلَالٍ مُّبِينٍ‏}‏ ‏[‏الأحقاف‏:‏32]‏،

‘‘আর যে আল্লাহর দিকে আহবানকারীর প্রতি সাড়া দিবে না, দুনিয়াতে সে আল্লাহকে ব্যর্থ করতে পারবে না, আর আল্লাহকে বাদ দিয়ে নেই তার কোন সাহায্যকারী, পৃষ্ঠপোষক। তারা আছে সুস্পষ্ট গুমরাহীতে।’ (আল-আহক্বাফ ৪৬ : ৩২)

{‏وَأَنَّا ظَنَنَّا أَن لَّن نُّعجِزَ اللهَ فِي الأَرْضِ وَلَن نُّعْجِزَهُ هَرَبًا‏}‏ ‏[‏الجن‏:‏12‏]‏‏.‏

‘‘আমরা বুঝতে পেরেছি যে, আমরা পৃথিবীতে আল্লাহকে পরাস্ত করতে পারব না, আর পালিয়েও তাঁকে অপারগ করতে পারব না।’ (আল-জিন ৭২: ১২)

এ সাহায্য ও সুসংবাদের মাধ্যমে তাঁকে তাঁর যত প্রকারের চিন্তা-ভাবনা, দুঃখ-কষ্ট এবং নৈরাশ্য, ত্বায়িফবাসীদের গালি-গালাজ, চাটিমারা ও প্রস্তর নিক্ষেপের কালো মেঘ সব কিছুই মন থেকে মুছে গেল। তিনি সংকল্পবদ্ধ হলেন তাঁকে মক্কায় ফিরে যেতেই হবে এবং নতুনভাবে ইসলামের দাওয়াত ও নবুওয়াতের তাবলীগ পূর্ণোদ্যমে আরম্ভ করতে হবে। এটা ছিল ঐ সময়ের কথা যখন যায়দ বিন হারিসাহ (রাঃ) তাঁকে বলেছিলেন, ‘মক্কাবাসীগণ অর্থাৎ কুরাইশগণ যে অবস্থায় আপনাকে মক্কা থেকে বিতাড়িত করেছে সে অবস্থায় কিভাবে আপনি মক্কা প্রত্যাবর্তন করবেন?’ উত্তরে তিনি বলেছিলেন, ‘হে যায়দ! তুমি যে অবস্থা দেখছ এর একটা সুরাহা অবশ্যই হবে এবং আল্লাহ তা‘আলা অবশ্যই এ থেকে পরিত্রাণের একটি পথ বের করে দেবেন। তাঁর মনোনীত দ্বীনকে প্রতিষ্ঠিত করার ব্যাপারে তিনি অবশ্যই সাহায্য করবেন এবং নিজ নাবী (সাঃ)-কে জয়ী করবেন।

নাবী কারীম (সাঃ) শেষ পর্যন্ত সেখান থেকে যাত্রা করলেন এবং মক্কার নিকটবর্তী হেরা পর্বতের পাদদেশে অবস্থান করলেন। তারপর খুযা’আহ গোত্রের একজন লোক মারফত আখনাস বিন শারীক্বের নিকট সংবাদ পাঠালেন যে তিনি যেন নাবী কারীম (সাঃ)-কে আশ্রয় প্রদান করেন। কিন্তু আখনাস এই বলে আপত্তি করলেন যে, কুরাইশরা হচ্ছেন তাঁর মিত্র। কাজেই তাঁদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে মুহাম্মাদ (সাঃ)-কে আশ্রয় প্রদান তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়।

এরপর তিনি সুহায়েল বিন ‘আমর এর নিকট ঐ একই অনুরোধ বার্তা প্রেরণ করলেন। কিন্তু তিনিও এ কথা বলে আপত্তি জানালেন যে, বণী আমেরের আশ্রয় দেয়া বনু কা’বের জন্য (সঙ্গত) হয় না। অতঃপর নাবী সাঃ মুত্ব’ঈম বিন আদির নিকট বার্তা প্রেরণ করলেন। মুত্ব’ঈম বললেন, হাঁ, অতঃপর অস্ত্র সজ্জিত হয়ে নিজ পুত্রগণ এবং সম্প্রদায়কে ডাকলেন এবং বললেন, তোমরা অস্ত্রসজ্জিত হয়ে ক্বাবা’হ ঘরের নিকটে একত্রিত হয়ে যাও, কেননা আমি মুহাম্মাদ সাঃ-কে আশ্রয় দিয়ে দিয়েছি। অতঃপর মুত্বঈম নাবী কারীম (সাঃ)-এর নিকট খবর পাঠালেন মক্কায় আগমনের জন্য। তিনি খবর পেয়ে যায়িদ বিন হারিসাহকে সঙ্গে নিয়ে মক্কায় আগমন করে মসজিদুল হারামে প্রবেশ করেন। এরপর মুত্ব’ঈম বিন আদী আগমন করে মসজিদুল হারামে প্রবেশ করেন। এরপর মুত্ব’ঈম বিন আদী আপন বাহনের উপর দৌড়িয়ে উচ্চ কণ্ঠে ঘোষণা করলেন যে, ‘হে কুরাইশগণ, আমি মুহাম্মাদ (সাঃ)-কে আশ্রয় প্রদান করেছি, কেউ যেন তাঁকে আর অনর্থক হয়রান না করে।’

এ দিকে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) সোজা হাজরে আসওয়াদের নিকট গিয়ে তা চুম্বন করেন। তারপর দু’রাকায়াত সালাত আদায় করেন এবং অস্ত্রসজ্জিত মুত্ব’ঈম বিন আদী ও তাঁর লোকজন পরিবেষ্টিত হয়ে গৃহে প্রত্যাবর্তন করেন। বলা হয়, এ সময় আবূ জাহল মুত্ব’ঈমকে জিজ্ঞাসা করেছিল, ‘তুমি মুহাম্মাদ (সাঃ)-কে আশ্রয় দিয়েছ না মুসলিমগণের অনুসারী হয়ে গিয়েছ?’ উত্তরে মুত্ব’ঈম বলেছিলেন, ‘আমি তাঁকে আশ্রয় দিয়েছি।’ এর উত্তরে আবূ জাহল বলেছিল, ‘তুমি যাঁকে আশ্রয় দিয়েছ, আমিও তাঁকে আশ্রয় দিলাম’’।[5]

মুত্ব’ঈম বিন আদির সৌজন্য ও সহৃদয়তার কথা রাসূলুল্লাহ (সাঃ) কখনও ভুলেন নি। যখন বদরের যুদ্ধে মক্কার কাফেরদের একটি দল বন্দী হয়ে আসে এবং কোন বন্দীর মুক্তির জন্য জুবায়ের বিন মুত্ব’ঈম নাবীজী (সাঃ)-এর দরবারে আগমন করেন তখন তিনি বললেন,

‏(‏لَوْ كَانَ الْمُطْعِمُ بْنُ عَدِىٍّ حَيًّا ثُمَّ كَلَّمَنِىْ فِيْ هٰؤُلَاءِ النَّتْنٰى لَتَرَكْتُهُمْ لَهُ‏)

অর্থঃ যদি মুত্ব’ঈম বিন আদী জীবিত থাকত এবং এই দুর্গন্ধময় মানুষগুলোর জন্য সুপারিশ করত তাহলে তাঁর খাতিরে ওদেরকে ছেড়ে দিতাম।[6]

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button

Adblock Detected

Please consider supporting us by disabling your ad blocker