মুসলিম হওয়ার শর্তাবলি- পার্ট -৩
আল্লাহ তাআলা যেরূপ অনাদি, তাঁর কালামও অনাদি। তবে আমাদের পঠিত ও লিখিত আয়াতগুলোর শব্দ ও লেখাগুলো সৃষ্ট।
ঈমান শুধু সত্য গ্রহণ নয়, অসত্য বর্জনও
-
কোনো আকিদা মেনে নেওয়ার পাশাপাশি তার বিপরীত বিষয়কেও সঠিক মনে করা স্ববিরোধিতা, কোনো সুস্থ বুদ্ধি তা গ্রহণ করতে পারে না। ঈমান তখনই সাব্যস্ত হবে, যখন বিপরীত সব কিছু বাতিল ও মিথ্যা মনে করবে এবং তা থেকে সম্পর্ক ছিন্ন করবে। সব ধরনের শিরক, কুফর ও অনৈসলামিক রীতিনীতি থেকে সম্পর্ক ছিন্ন করা ঈমানের অংশ। ইবরাহিম (আ.) তাঁর জাতিকে বলেছিলেন, ‘হে আমার সম্প্র্রদায়! তোমরা যাকে আল্লাহর শরিক করো তার সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক নেই। আমি একনিষ্ঠভাবে তাঁর দিকে মুখ ফেরাচ্ছি, যিনি আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন এবং আমি মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত নই। ’ (সুরা : আনআম, আয়াত : ৭৮-৭৯) মোটকথা, ধর্মহীনতা যেমন কুফর, তেমনি ইসলাম ছাড়া অন্য কোনো দ্বিন অন্বেষণ করাও কুফর। সত্য আকিদাগুলো গ্রহণ করা আর কুফরি কর্ম ও বিশ্বাস থেকে সম্পর্কহীনতা অবলম্বন করা—এ দুয়ের সমষ্টির দ্বারা ঈমান অস্তিত্ব লাভ করে। ঈমান ও ঈমান বিনষ্টকারী বিষয় একত্র হতে পারে না।
মৌলিক যেসব বিষয়ে ঈমান রাখা অপরিহার্য
মৌলিকভাবে ছয়টি বিষয়ে ঈমান রাখতে হয়। যথা—
১. আল্লাহর প্রতি ঈমান।
২. ফেরেশতাদের প্রতি ঈমান।
৩. আল্লাহর নাজিলকৃত সব কিতাবের প্রতি ঈমান।
৪. আল্লাহর প্রেরিত সব নবী-রাসুলের প্রতি ঈমান।
৫. আখিরাতের প্রতি ঈমান।
৬. তাকদিরের প্রতি ঈমান।
-
মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন, ‘রাসুল তার নিকট তার রবের পক্ষ থেকে নাজিলকৃত বিষয়ের প্রতি ঈমান এনেছে, আর মুমিনগণও। প্রত্যেকে ঈমান এনেছে আল্লাহর ওপর, তাঁর ফেরেশতাকুল, কিতাবসমূহ ও তাঁর রাসুলগণের ওপর, আমরা তাঁর রাসুলগণের কারো মধ্যে তারতম্য করি না। আর তারা বলে, আমরা শুনলাম এবং মানলাম। হে আমাদের রব! আমরা আপনারই ক্ষমা প্রার্থনা করি, আর আপনার দিকেই প্রত্যাবর্তনস্থল। ’ (সুরা : বাকারাহ, আয়াত : ২৮৫) একটি হাদিস শরিফে জিবরাঈল (আ.)-এর প্রশ্নের উত্তরে রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, ‘ঈমান হলো আল্লাহ, ফেরেশতাগণ, কিতাবসমূহ, রাসুলগণ, আখিরাত ও ভালো-মন্দ তাকদিরের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করা। ’ (বুখারি, হাদিস : ৫০; মুসলিম, হাদিস : ১)
পরকালে বিশ্বাসের মর্মকথা
-
কিয়ামত সংঘটিত হওয়ার দ্বারা জগৎ ধ্বংস হয়ে যাবে। এরপর আল্লাহ তাআলা সব প্রাণীকে পুনরুত্থিত করবেন। সব মানুষ ও জিন পুনরুত্থানের পর নিজ নিজ কৃতকর্মের ফল ভোগ করবে। মুসলিমরা কিয়ামতের পর পুনরুত্থানে বিশ্বাসী, তবে দুনিয়ায় পুনর্জন্মবাদে বিশ্বাসী নয়। আখিরাত বিষয়ক নিম্নের বিশ্বাসগুলোও অপরিহার্য :
কবরে সওয়াল-জবাব অনিবার্য সত্য। (তিরমিজি, হাদিস : ১০৭১)
-
মুমিনদের কবরে শান্তি পাওয়া এবং কাফির ও গুনাহগারদের আজাব হওয়া সত্য। তা জীবিত মানুষদের বোধগম্য নয়, কেননা তা আলমে বারজাখে হয়ে থাকে। (মুসলিম, হাদিস : ৯০৫)
শারীরিক ও আত্মিক উভয়ভাবে পুনরুত্থান এবং হাশরের ময়দানে বিচার ও হিসাব-নিকাশ সত্য।
(সুরা : জুমার, আয়াত : ৬৮; সুরা : ইয়াসিন, আয়াত : ৭৮-৭৯)
ভালো-মন্দ আমলের ওজন করা অনিবার্য সত্য। (সুরা : আম্বিয়া, আয়াত : ৪৭)
-
নেককারদের আমলনামা ডান হাতে এবং বদকারদের আমলনামা বাঁ হাতে দেওয়া হবে। (সুরা : হাক্কা, আয়াত : ১৯-২৯; সুরা : কাহ্ফ, আয়াত : ৪৯)
-
আমাদের নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর সর্বশ্রেষ্ঠ সুপারিশ এবং পরবর্তী সময়ে আল্লাহর হুকুমে ফেরেশতা, নবীগণ ও সৎ মুমিনদের সুপারিশ অনিবার্য সত্য।
(বুখারি, হাদিস : ৪৪৭৬; মুসলিম, হাদিস : ৩২২)
-
আমাদের নবী (সা.) কাউসার নামক নহর থেকে নেককার উম্মতকে পানি পান করাবেন। (সুরা : কাউসার, আয়াত : ১; বুখারি, হাদিস : ৬৫৭৯; মুসলিম, হাদিস : ২২৯৫)
-
জাহান্নামের ওপর দিয়ে চুলের চেয়েও চিকন ও তরবারির চেয়েও ধারালো পুল পার হওয়া অনিবার্য সত্য। নেককাররা তাদের আমল অনুপাতে দ্রুতগতিতে পার হবে। আর গুনাহগাররা হোঁচট খেয়ে পড়ে যাবে, অথবা তাদের টেনে জাহান্নামে ফেলে দেওয়া হবে। (বুখারি, হাদিস : ৮০৬; মুসলিম, হাদিস : ২৯৯)
নেককাররা আল্লাহর রহমতে জান্নাতে যাবে এবং বদকাররা আল্লাহর ন্যায়বিচারে জাহান্নামে যাবে।
গুনাহগার ঈমানদারদের কাফির বলা হবে না এবং তারা চিরজাহান্নামিও হবে না। (সুরা : নিসা, আয়াত : ৪৮)
মুমিনরা চিরজান্নাতি এবং কাফিররা চিরজাহান্নামি হবে।
(সুরা : বায়্যিনাহ, আয়াত : ৬-৮)
পরকালে মুমিনরা আল্লাহ তাআলাকে স্বচক্ষে দেখবে।
(সুরা : ক্বিয়ামাহ, আয়াত : ২২-২৩; বুখারি, হাদিস : ৫৫৪)
সব নবী-রাসুলের ওপর ঈমান আনার মর্মকথা
-
মহান আল্লাহ যুগে যুগে মানুষ ও জিনের হিদায়াতের জন্য তাঁর মনোনীত নবী-রাসুলদের প্রেরণ করেছিলেন। তাঁরা আল্লাহর বাণীকে তাঁদের কথা ও কাজ দ্বারা বান্দাদের প্রতি পৌঁছে দিয়েছিলেন। তাঁদের সংখ্যা অকাট্যভাবে প্রমাণিত না হলেও একটি বর্ণনা দ্বারা জানা যায় যে তাঁদের সংখ্যা এক লাখ ২৪ হাজার। (মুসনাদে আহমাদ, হাদিস : ২২২৮৮) তাঁদের মধ্যে সর্বপ্রথম হলেন আদম (আ.) এবং সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ হলেন মুহাম্মদ (সা.)। নবীদের ব্যাপারে নিম্নোক্ত বিশ্বাসগুলো রাখতে হবে :
নবুয়ত ও রিসালাতের দায়িত্ব আল্লাহ প্রদত্ত দয়া ও অনুগ্রহ। কেউ পরিশ্রম করে নবী-রাসুল হতে পারবে না। (সুরা : বাকারা, আয়াত : ১০৫)
নবী-রাসুলগণ সর্বযুগের সব মানুষের চেয়ে শ্রেষ্ঠ। (সুরা : হাজ্জ, আয়াত : ৭৫)
তাঁরা মাটির তৈরি সর্বোৎকৃষ্ট মানুষ। তাঁরা আল্লাহও নন, আল্লাহর পুত্রও নন। (সুরা : তাওবা, আয়াত : ৩০)।
নবী-রাসুলদের প্রতি ঈমান আনা ব্যতীত আল্লাহর প্রতি ঈমান গ্রহণযোগ্য নয়। (সুরা : নিসা, আয়াত : ১৫০)
নবী-রাসুলরা সবাই ছোট-বড় গুনাহ থেকে নিষ্পাপ। সবাই ন্যায়ের পথে ছিলেন। (শরহুল ফিকহিল আকবার, পৃষ্ঠা ১৬)
তাঁরা আল্লাহর বাণী উম্মতদের কাছে যথাযথ পৌঁছিয়েছিলেন, তাতে কোনো ত্রুটি করেননি। (সুরা : আহযাব, আয়াত : ৩৯)
-
আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের সর্বসম্মতিক্রমে নবীরা ইন্তেকালের পর শহীদদের চেয়েও বেশি জীবন ও অনুভূতিসম্পন্ন। যদিও তা দুনিয়ার জীবনের ন্যায় জীবন নয়। (দেখুন—সহিহ মুসলিম, হাদিস : ২৩৭৫; মুসনাদে আবি ইয়ালা, হাদিস : ৩৪২৫, হাদিসটির সনদ সহিহ)
তাকদিরে বিশ্বাসের মর্মকথা
-
ভালো-মন্দ তাকদিরের সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ তাআলা। সব সৃষ্টির ব্যাপারে লাওহে মাহফুজে আগে থেকেই শুরু-শেষ, ভালো-মন্দ বিস্তারিত কুদরতি কলম দ্বারা লিপিবদ্ধ ও নির্ধারিত আছে। মানব-দানবের ভালো-মন্দ তাকদির আল্লাহ তাআলা আলিমুল গাইব হিসেবে আগে থেকেই লিখে রাখলেও মানুষ কোনো কাজে বাধ্য ও অক্ষম নয়, বরং আল্লাহ তাআলা সবাইকে নিজ নিজ ইচ্ছাশক্তি দান করেছেন, যা কাজে লাগিয়ে সে ভালো-মন্দ কাজ করে থাকে। এ জন্যই ভালো কাজে পুরস্কার এবং মন্দ কাজে শাস্তির বিধান রয়েছে। তাকদির নিয়ে বেশি গবেষণা ও বাড়াবাড়ি নিষেধ। কেননা তা আল্লাহ তাআলার কুদরতের একটি রহস্য। (সুরা : আনআম, আয়াত : ৫৯; মুসলিম, হাদিস : ১; বুখারি, হাদিস : ৪৯৪৫; তিরমিজি, হাদিস : ২১৩৩)