রাসূল (সাঃ) এর হিযরত
আল্লাহু সুবহানাহু ওয়া তা’আলার ইচ্ছে ও কুরাইশদের প্রচেষ্টা
তারা তাদের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্য এমন জঘন্য পরামর্শ সভা অত্যন্ত গোপনে করে যাতে কার্যসিদ্ধির আগ পর্যন্ত কেউ জানতে না পারে। তারা তাদের এতদিন যাবৎ প্রতিরোধের ধরণে পরিবর্তন নিয়ে আসে যা পূর্বের সব সিদ্ধান্তের চেয়ে নিতান্ত ভয়াবহ ও লোমহর্ষক। এটা ছিল কুরাইশদের চক্রান্ত। অন্যদিকে আল্লাহ তা’আলাও কৌশল অবলম্বন করলেন। তাদেরকে এমনভাবে ব্যর্থ করে দেয়া হলো যে তারা বুঝতেও পারল না। তখন জিবরাঈল (আঃ) মহান ও বরকতময় প্রভুর তরফ থেকে আল্লাহর বাণী নিয়ে তার সম্মুখে উপস্থিত হলেন এবং তাকে কুরাইশ মুশরিকদের ষড়যন্ত্রের কথা জনালেন। তিনি বললেন যে, ‘আপনার প্রভু পরওয়ারদেগার মক্কা থেকে হিজরত করার অনুমতি প্রদান করেছেন জিবরাঈল (আঃ) তাঁকে হিজরতের সময় নির্ধারণ করে দিলেন এবং কুরাইশদের কিভাবে প্রতিহত করতে হবে তা বলে দিলেন। অতঃপর বললেন, আপনি এ যাবৎ যে শয্যায় শয়ন করে এসেছেন আজ রাত্রে সে শয্যায় শয়ন করবেন না।
হিজরত সংক্রান্ত আল্লাহর বাণী প্রাপ্ত হওয়ার পর নাবী কারীম (সাঃ) ঠিক দুপুরে আবূ বাকর (রাঃ)-এর গৃহে তশরীফ আনয়ন করলেন। উদ্দেশ্য ছিল, হিজরতের সময় এবং পন্থা প্রক্রিয়া সম্পর্কে আলোচনা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা। ‘আয়িশাহ (রাঃ) বর্ণনা করেছেন, ‘আমরা আব্বাস (আবূ বাকর (রাঃ)-এর) বাড়ীতে ঠিক দুপুরে বসেছিলাম তখন এক ব্যক্তি এসে খবর দিল যে, নাবী কারীম (সাঃ) মাথা ঢেকে আগমন করছেন। এটা দিবা ভাগের এমন সময় ছিল যে সময় রাসূলুল্লাহ (সাঃ) সাধারণতঃ কোথাও যেতেন না। আবূ বাকর (রাঃ) বললেন ‘আমার মাতা-পিতা আপনার জন্য কোরবান হোক, আপনি এ সময় কোন্ গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আলোচনার জন্য আগমন করেছেন?’
‘আয়িশাহ (রাঃ) বর্ণনা করেছেন, ‘রাসূলুল্লাহ (সাঃ) ভিতরে আসার অনুমতি চাইলেন, তাঁকে ভিতরে আসার অনুমতি দেয়া হলে তিনি ভিতরে প্রবেশ করলেন। তারপর আবূ বাকর (রাঃ)-কে বললেন, ‘আপনার কাছে যে সকল লোক রয়েছে তাদের সরিয়ে দিন।’
আবূ বাকর বললেন, ‘যথেষ্ট, আপনার গৃহিনী ছাড়া এখানে আর কেউই নেই। আপনার প্রতি আমার মাতা-পিতা কুরবান হোক, হে আল্লাহর রাসূল (সাঃ)।
তিনি বললেন, ‘ভাল, হিজরত করার জন্য আল্লাহ রাববুল আলামীনের তরফ থেকে আমাকে অনুমতি প্রদান করা হয়েছে।
আবূ বাকর বললেন, ‘সাথে… হে আল্লাহর (সাঃ)! আপনার প্রতি আমার পিতামাতা উৎসর্গ হোক।
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বললেন, ‘হ্যাঁ’’।
তারপর হিজরতের সময় সূচী নির্ধারণ করে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) আপন গৃহে প্রত্যাবর্তন করলেন এবং রাতের আগমনের জন্য প্রতীক্ষারত রইলেন। তিনি (সাঃ) এ দিন এমনভাবে প্রস্তুতি নিলেন যে, হিজরতের উদ্দেশ্যে তাঁর প্রস্তুতির কথা কেউ জানতে পারল না। নচেৎ জানতে পারলে অন্য যে কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে কুরাইশরা দ্বিধাবোধ করতো না।
রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর বাড়ি ঘেরাও
এক দিকে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) যখন হিজরতের প্রস্তুতি গ্রহণ করতে থাকলেন, অন্য দিকে মক্কার পাপিষ্ঠরা দারুন নাদওয়ার সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের প্রস্তুতি গ্রহণ করতে থাকল। উদ্দেশ্য সাধনের জন্য নিম্ন তালিকাভুক্ত এগার জন পাপীষ্ঠকে নির্বাচন করা হল। তাদের নাম হচ্ছে যথাক্রমেঃ
(১) আবূ জাহল বিন হিশাম, (২) হাকাম বিন আবীল ‘আস, (৩) উক্ববা বিন আবূ মু’আইত্ব, (৪) নাযর বিন হারিস (৫) উমাইয়া বিন খাআফ, (৬) যাম’আহ বিন আসওয়াদ, (৭) তু’আইইমা বিন আদী, (৮) আবূ লাহাব, (৯) উবাই বিন খালাফ, (১০) নুবাইহ বিন হাজ্জাজ এবং তার ভাই (১১) মুনাব্বিহ বিন হাজ্জাজ।
রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর স্বভাবগত অভ্যাস ছিল তিনি এশার সালাত পর রাত্রের প্রথম প্রহরে ঘুমিয়ে যেতেন এবং অর্ধ রাত্রিতে জেগে মাসজিদুল হারামে চলে যেতেন। তিনি (সাঃ) সেখানে তাহাজ্জুদের সালাত আদায় করতেন। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) ‘আলী (রাঃ)-কে বললেন, ‘তুমি আমার এ সবুজ হাযরামী[2] চাদর গায়ে দিয়ে আমার বিছানায় ঘুমিয়ে থাক। তারা তোমার ক্ষতি করতে পারবে না।
অতঃপর রাতের এক তৃতীয়াংশ গত হলো, ধরনীতে নিস্তব্ধতা নেমে এল এবং অধিকাংশ মানুষ ঘুমিয়ে পড়ল- এমন সময় উল্লেখিত ব্যক্তিবর্গ অতি গোপনে রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর বাড়িতে হাজির হলো। তাঁকে বাধা দেওয়ার জন্য তারা রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর ঘরের দরজায় অবস্থান করলো। তাদের ধারণা ছিল, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) ঘুমিয়ে আছেন, তিনি যখনই বেন হবেন তারা তাঁর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তাদের চক্রান্ত বাস্তবায়ন করবে।
তাদের এ ঘৃণ্য পরিকল্পনা বাস্তবায়ণ ও কার্যকর করার ব্যাপারে তাদের অবস্থা এতই দৃঢ় ছিল যে, কিছুক্ষণের মধ্যেই তারা কেলাহ ফতেহ করে দেবে। আবূ জাহল চরম অহংকার, উপহাস ও তাচ্ছিল্যের সঙ্গে নাবী (সাঃ)-এর গৃহ ঘেরাওকারী আপন সঙ্গীদের বলল, ‘মুহাম্মাদ (সাঃ) বলছে যে, যদি তোমরা তার ধর্মে প্রবেশ কর, তার অনুসরণ কর তাহলে অনারবদের উপর আরবদের শাসন ক্ষমতা প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাবে। মৃত্যুর পরে আবার যখন তোমাদের উঠানো হবে তখন উরদুনের বাগান সমূহের মতো বাগান দেয়া হবে। আর যদি তোমরা তা না কর তাহলে তার পক্ষ থেকে তোমাদের উপর হত্যাযজ্ঞ চালানো হবে। আর এ অবস্থায় মৃত্যুর পর আবার যখন তোমাদের উঠানো হবে তখন ঠিকানা হবে জাহান্নাম। সেখানে না কি অনন্ত কাল জাহান্নামের আগুনে জ্বলতে হবে।
যাহোক, জঘন্যতম এ পাপাচার অনুষ্ঠানের জন্য নির্ধারিত সময় ছিল রাত দুপুরের পরক্ষণ। এ জন্য তারা রাত জেগে সময় কাটাচ্ছিল এবং নির্ধারিত সময়ের জন্য প্রতীক্ষারত ছিল। কিন্তু আল্লাহর ব্যবস্থাই হচ্ছে চূড়ান্ত এবং তাঁর বিজয়ই হচ্ছে প্রকৃত বিজয়। তাঁরই একক এখতিয়ারে রয়েছে আসমান ও জমিনের একচ্ছত্র আধিপত্য। তিনি যা চান তাই করেন। তিনি যাঁকে বাঁচাতে চান কেউই তাঁর কেশাগ্রও স্পর্শ করতে পারে না। আবার তিনি যাকে পাকড়াও করতে চান পৃথিবীর কোন শক্তিই তাকে রক্ষা করতে পারে না।