সাহাবাদের ইসলাম গ্রহণ পর্ব ৪
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর সাথে কুরাইশ নেতৃবৃন্দের কথোপকথন (رؤساء قريش يفاوضون رسول الله):
কুরাইশগণ উক্তরূপ উত্তকে একেবারে নিরাশ হয়ে যায় নি কেননা তিনি (সাঃ) তাদেরকে স্পষ্ট করে কিছু বলেন নি, বরং উতবাহকে কয়েকটি আয়াত তেলাওয়াত করে শুনিয়েছেন মাত্র। অতঃপর ‘উতবাহ সেখান হতে ফিরে এসেছে। ফলে কুরাইশ নেতৃবৃন্দ পরস্পরে যাবতীয় বিষয়াদী সম্পর্কে পরামর্শ ও চিন্তা-ভাবনা করল।
অতঃপর একদিবসে তারা মাগরিবের পর কা’বাহর সম্মুখে একত্রিত হয়ে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) কে ডেকে পাঠালে তিনি (সাঃ) দ্রুত সেখানে হাজির হলেন এমন মনে করে যে, তাতে হয়তো কোন কল্যাণ রয়েছে। যখন তিনি (সাঃ) তাদের মাঝে আসন গ্রহণ করলেন, তারা উতবাহর অনুরূপ প্রস্তাব পেশ করল। তাদের ধারণা ছিল যে, সেদিন ‘উতবাহ একা একা প্রস্তাব করাতে মুহাম্মাদ সম্মত হয়নি; তবে সবাই সম্মিলিতভাবে প্রস্তাব করলে তা মেনে নিবেন অবশ্যই। কিন্তু তাদের প্রস্তাব শোনার পর রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বললেন, তোমরা আমার ব্যাপারে এসব কি বলছ, আমি তোমাদের নিকটে কোন ধন-সম্পদ ও মর্যাদা চাই না। তোমাদের নিটক কোন রাজত্ব চাই না। তবে আল্লাহ তা’আলা আমাকে তোমাদের প্রতি রাসূল হিসেবে প্রেরণ করেছেন, তাঁর পক্ষ হতে আমার উপর কিতাব অবতীর্ণ করেছেন। আর আমাকে এ মর্মে নির্দেশ দেয়া হয়েছে, যেন আমি তোমাদেরকে ভাল কর্মের উত্তম ফলাফলের শুভসংবাদ দেই এবং অন্যায় ও পাপকর্মের শাস্তি সম্পর্কে ভীতি প্রদর্শন করি। সুতরাং আমি তোমাদের নিকট আমি রিসালাতের বাণী পৌছিয়ে দিচ্ছি এবং সৎ উপদেশ প্রদান করছি। আমি যা নিয়ে প্রেরিত হয়েছি তা যদি তোমরা মেনে নাও তাহলো দুনিয়া ও আখিরাতে এর ভাল পরিণাম ভোগ করবে। আর যদি আমার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করো তবে আমার ও তোমাদের মধ্যে আল্লাহর ফায়সালা না আসা পর্যন্ত ধৈৰ্য্য ধারণ করে যাবো।
তারা ব্যর্থ মনোরথ হয়ে ফিরে গিয়ে আরেক পদক্ষেপ গ্রহণ করলো। তা হলো তারা রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর কাজে দাবি জানালো যে, নাবী (সাঃ) যেন তাদের জমিন থেকে পাহাড়সমূহ দূরীভূত করে দেন, তাদের জমিন প্রশস্থ করে দেন। অতঃপর সেই জমিনে ঝর্ণা ও নদ-নদী প্রবাহিত করে দেন। আর তিনি (সাঃ) যেন তাদের মৃতদেরকে জীবিত করে দেন; বিশেষ করে কুসাই বিন কিলাবকে। তিনি (সাঃ) এসব কর্ম সম্পাদন করলেই কেবল তারা ঈমান আনবে। তাদের এ কথার জবাবে রাসূল (সাঃ) পূর্বের ন্যায় জবাব দিলেন।
এরপর তারা আবার অন্য একটি বিষয় উত্থাপন করলো- তারা বললো নাবী (সাঃ) যেন তার প্রভুর নিকট একজন ফেরেশতাকেও নাবী করে পাঠান যিনি মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর দাবীকে সত্যায়ন করবে। আর আল্লাহ তা’আলা যেন তাঁকে বাগ-বাগিচা, ধন-সম্পদ ও স্বর্ণের অট্টালিকা প্রদান করেন। এবারও রাসূল (সাঃ) একই জবাব দিলেন।
অতঃপর তারা চতুর্থ একটি বিষয় উপস্থাপন করলো- মুহাম্মাদ যেহেতু তাদের শাস্তির ভয় দেখায় সুতরাং কুরাইশরা নাবী (সাঃ) এর কাছে আযাব আনয়ন করার দাবি জানালো এবং এও বললো তাদের উপর যেন আকাশ হয়ে পড়ে। (আল্লাহ তা’আলা যথাসময়ে এটা সম্পাদন করবেন।)
শেষ পর্যায়ে তারা ভীষণ হুমকি দিল এমনকি তারা বললো, আমরা তোমাকে সহজে ছেড়ে দেবনা, এতে হয় আমরা তোমাকে শেষ করবো অথবা আমরা নিঃশেষ হবো। তাদের এ ধরনের ধমকি শোনার পর রাসূলুল্লাহ (সাঃ) অত্যন্ত চিন্তান্বিত হয়ে স্বীয় পরিবারবর্গের নিকটে ফিরে গেলেন।
রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে হত্যার ব্যাপারে আবূ জাহলের অস্বীকার (عزم ابي جهل على قتل رسول الله):
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) যখন কুরাইশ নেতৃবৃন্দের নিকট হতে ফিরে আসলেন তখন আবূ জাহল কুরাইশ নেতৃবৃন্দের মধ্যে ঘোষণা দিয়ে বললো, ‘কুরাইশ ভ্রাতৃবৃন্দ। আপনার সম্যকরূপে অবগত আছেন যে, মুহাম্মাদ (সাঃ) আমাদের ধর্মে কলঙ্ক রটাচ্ছে, আমাদের পূর্বপুরুষের নিন্দা করছে, আমাদের জ্ঞান বুদ্ধিকে খাটো বলে রটনা করছে এবং দেবদেবীগণের অবমাননা করছে। এ সব কারণে আল্লাহ তা’আলার শপথ করে বলছি যে, আমি এক খণ্ড ভারী এবং সহজে উঠানো সম্ভব এমন পাথর নিয়ে বসব এবং মুহাম্মাদ (সাঃ) যখন সিজদায় যাবে তখন সেই পাথর মেরে তার মাথা চূর্ণ করে ফেলব। এখন এ অবস্থায় তোমরা আমাকে এক অসহায় ছেড়ে দাও, আর না হয় সাহায্য কর। বনু আবদে মানাফ এর পর যা চাই তা করুক’। উপস্থিত লোকেরা বলল, ‘আল্লাহর শপথ! আমরা তোমাকে অসহায় ছেড়ে দিতে পারি না। তুমি যা করার ইচ্ছে করেছ তার করে ফেল।
সকাল হলে আবূ জাহল তার ঘোষণার অনুরূপ একখণ্ড পাথর নিয়ে রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর অপেক্ষায় বসে থাকল। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) যথা নিয়মে আগমন করলেন এবং সালাতে রত হলেন। কুরাইশগণও সেখানে উপস্থিত হয়ে আবূ জাহলের কথিত কাণ্ড দেখার জন্য অপেক্ষামান রইল। যখন রাসূলুল্লাহ (সাঃ) সিজদায় গমন করলেন তখন আবূ জাহল পাথর উঠিয়ে তাঁর দিকে অগ্রসর হল, কিন্তু নিকটে পৌঁছে পরাস্ত সৈনিকের মতো স্ববেগে পশ্চাদপসরণ করল। এ সময় তাকে অত্যন্ত বিবর্ণ এবং ভীত সন্ত্রস্ত দেখাচ্ছিল। তার দু’হাত পাথরের সঙ্গে শক্তভাবে চিমটে লেগে গিয়েছিল। পাথরের গা থেকে হাত ছাড়াতে তাকে যথেষ্ট কষ্ট করতে এবং বেগ পেতে হয়েছিল।
এ দিকে কুরাইশগণের মধ্য থেকে কিছু সংখ্যক লোক দ্রুত তার নিকট এগিয়ে আসে এবং বলতে থাকে, আবূল হাকাম! ব্যাপারটি হল কী? কিছুই যেন বুঝে উঠছি না।
সে বলল, ‘আমি রাত্রিবেলা যা বলেছিলাম তা করার জন্যই এগিয়ে যাচ্ছিলাম। কিন্তু যখন তাঁর নিকটে গিয়ে পৌঁছলাম তখন একটি উট আমার সামনে প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়াল। হায় আল্লাহ! কক্ষনো আমি এমন মস্তক, এমন ঘাড় এবং এমন দাঁতবিশিষ্ট উট দেখি নি। মনে হল সে যেন আমাকে খেয়ে ফেলতে চাচ্ছে।
ইবনে ইসহাক্ব বলেন, আমাকে বলা হয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) ইরশাদ করেছেন, ‘উষ্ট্রের রূপ ধারণ করে সেখানে ছিলেন জিবরাঈল (আঃ)। আবূ জাহল যদি আমার নিকট যেত তাহলে তার উপর বিপদ অবতীর্ণ হয়ে যেত।[1]