নবীদের জীবনী

হযরত মুহাম্মাদ (ছাঃ) এর জীবনী পর্ব ৪ – নবুঅত লাভ ও ছালাতের নির্দেশনা

পূর্বের অংশ পড়ুন: হযরত মুহাম্মাদ (ছাঃ) এর জীবনী পর্ব ৩ – শিশু, যুবক ও ব্যবসায়ী মুহাম্মাদ

নবুঅতের দ্বারপ্রান্তে নিঃসঙ্গপ্রিয়তা :

নবুঅত লাভের সময়কাল যতই ঘনিয়ে আসতে লাগল, তাঁর মধ্যে নিঃসঙ্গপ্রিয়তার প্রবণতা ততই বাড়তে লাগল। এক সময় তিনি কা‘বা গৃহ থেকে প্রায় ৬ কিঃ মিঃ উত্তর-পূর্বে হেরা পাহাড়ের চূড়ায় অবস্থিত ৪´১১/৩ গজ আকারের ছোট গুহার নিরিবিলি স্থানকে বেছে নিলেন। বাড়ী থেকে পানি ও ছাতু নিয়ে যেতেন। ফুরিয়ে গেলে আবার আসতেন। কিন্তু বাড়ীতে তার মন বসতো না। কখনো কখনো সেখানে রাত কাটাতেন। পরপর ২টি রামাযান তিনি সেখানে ই‘তেকাফে কাটান।

বয়স চল্লিশে পদার্পণ করল। রবীউল আউয়ালের জন্ম মাস থেকে শুরু হ’ল ‘সত্য স্বপ্ন’ (الرؤيا الصادقة) দেখা। তিনি স্বপ্নে যাই দেখতেন তাই-ই দিবালোকের মত সত্য হয়ে দেখা দিত। এভাবে চলল প্রায় ছয় মাস। যা ছিল ২৩ বছরের নবুঅতকালের ৪৬ ভাগের এক ভাগ। হাদীছে সম্ভবত একারণেই সত্য স্বপ্নকে নবুঅতের ৪৬ ভাগের এক ভাগ বলা হয়েছে। রাসূলের নির্জনতা ও একাগ্রতা এমনভাবে বেড়ে গেল যে, এখন আর তিনি বাড়ী ফিরতে চান না। ফলে খাদীজা হেরা গুহা থেকে অল্পদূরে অবস্থান করতে থাকলেন। এসে গেল রামাযান মাস। পূর্বের ন্যায় এবারেও তিনি পুরা রামাযান সেখানে এ‘তেকাফে থাকার সিদ্ধান্ত নিলেন। খাদীজাও তাকে সেমতে খাদ্য সরবরাহ ও অন্যান্য সহযোগিতা করতে থাকলেন। স্বগোত্রীয় লোকদের পৌত্তলিক ও বস্ত্তবাদী ধ্যানধারণা তাকে পাগল করে তুলত। কিন্তু তাদের ফিরানোর কোন পথ তাঁর জানা ছিল না। মূলতঃ হেরা গুহায় নিঃসঙ্গ অবস্থানের বিষয়টি ছিল আল্লাহর মহতী ব্যবস্থাপনারই অংশ।

নুযূলে কুরআন :

এভাবে এসে গেল সেই শুভক্ষণ। ২১শে রামাযান সোমবারের ক্বদরের রাত্রি। ফেরেশতা জিবরীলের আগমন হল। ধ্যানমগ্ন মুহাম্মাদকে বললেন, اِقْرَأْ ‘পড়’। বললেন, مَاأَنَا بِقَاِرئ ‘আমি তো পড়তে জানিনা’। অতঃপর তাকে বুকে চেপে ধরলেন ও বললেন, পড়। কিন্তু একই জবাব, ‘পড়তে জানিনা’। এভাবে তৃতীয়বার আলিঙ্গন শেষে তিনি পড়তে শুরু করলেন,

اقْرَأْ بِاسْمِ رَبِّكَ الَّذِيْ خَلَقَ- خَلَقَ الْإِنْسَانَ مِنْ عَلَقٍ- اقْرَأْ وَرَبُّكَ الْأَكْرَمُ- الَّذِي عَلَّمَ بِالْقَلَمِ- عَلَّمَ الْإِنْسَانَ مَا لَمْ يَعْلَمْ-

(১) ‘পড় তোমার প্রভুর নামে যিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন’ (২) ‘সৃষ্টি করেছেন মানুষকে জমাট রক্ত থেকে’ (৩) ‘পড় এবং তোমার প্রভু বড়ই দয়ালু’ (৪) ‘যিনি কলমের সাহায্যে শিক্ষা দান করেছেন’ (৫) ‘তিনি মানুষকে শিক্ষা দিয়েছেন যা সে জানত না’।

মাত্র পাঁচটি আয়াত নাযিল হ’ল। তারপর ফেরেশতা অদৃশ্য হয়ে গেল। প্রথম কুরআন নাযিলের এই দিনটি ছিল ৬১০ খৃষ্টাব্দের ১০ই আগষ্ট সোমবার। ঐ সময় রাসূলের বয়স ছিল চান্দ্রবর্ষ হিসাবে ৪০ বছর ৬ মাস ১২ দিন এবং সৌরবর্ষ হিসাবে ৩৯ বছর ৩ মাস ২২ দিন।

নতুনের শিহরণ ও খাদীজার বিচক্ষণতা

নতুন অভিজ্ঞতা লাভে শিহরিত মুহাম্মাদ দ্রুত বাড়ী ফিরলেন। স্ত্রী খাদীজাকে বললেন, زَمِّلُوْنِى زَمِّلُوْنِى ‘শিগগীর আমাকে চাদর মুড়ি দাও। চাদর মুড়ি দাও’। কিছুক্ষণ পর ভয়ার্তভাব কেটে গেলে সব কথা খাদীজাকে খুলে বললেন। রাসূলের নিকটে খাদীজা কেবল স্ত্রী ছিলেন না, তিনি ছিলেন তাঁর নির্ভরতার প্রতীক ও সান্ত্বনার স্থান। ছিলেন বিপদের বন্ধু। তিনি অভয় দিয়ে বলে উঠলেন, এটা খারাব কিছু হ’তেই পারে না। كَلاَّ وَاللهِ لاَيُخْزِيْكَ اللهُ اَبَدًا ‘কখনোই না। আল্লাহর কসম! তিনি কখনোই আপনাকে অপদস্থ করতে পারেন না’।

إِنَّكَ لَتَصِلُ الرَّحِمَ وَتَحْمِلُ الْكَلَّ وَتَكْسِبُ الْمَعْدُوْمَ وَتَقْرِى الضَّيْفَ وَتُعِيْنُ عَلَى نَوَائِبِ الْحَقِّ

‘আপনি আত্মীয়দের সঙ্গে সদাচরণ করেন, দুস্থদের বোঝা বহন করেন, নিঃস্বদের কর্মসংস্থান করেন, অতিথিদের আপ্যায়ন করেন এবং বিপদগ্রস্তকে সাহায্য করেন’। অতঃপর তিনি তাঁকে সাথে নিয়ে চাচাতো ভাই অরাক্বা বিন নওফেলের কাছে গেলেন। যিনি ইনজীল কিতাবের আলেম ছিলেন এবং ঐ সময় চরম বার্ধক্যে অন্ধ হয়ে গিয়েছিলেন। তিনি সবকথা শুনে বললেন, هَذَا النَّامُوْسُ الَّذِيْ نَزَلَهُ اللهُ عَلَى مُوْسَى، يَا لَيْتَنِىْ فِيْهَا جَذْعًا، يَا لَيْتَنِىْ أَكُوْنُ حَيًّا إِذْ يُخْرِجُكَ قَوْمُكَ، ‘এ তো সেই ফেরেশতা যাকে আল্লাহ মূসার প্রতি নাযিল করেছিলেন। হায়! যদি আমি সেদিন তরুণ থাকতাম! হায়! যদি আমি সেদিন জীবিত থাকতাম, যেদিন তোমার কওম তোমাকে বহিষ্কার করবে’। একথা শুনে চমকে উঠে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, اَوَمُخْرِجِىَّ هُمْ ‘ওরা কি আমাকে বের করে দিবে’? অরাক্বা বললেন, نَعَمْ لَمْ يَأْتِ رَجُلٌ قَطُّ بِمِثْلِ مَا جِئْتَ بِهِ إِلاَّ عُوْدِىَ ‘হ্যাঁ! তুমি যা নিয়ে আগমন করেছ, তা নিয়ে ইতিপূর্বে এমন কেউ আগমন করেননি, যার সাথে শত্রুতা করা হয়নি’। অতঃপর অরাক্বা তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেন, إِنْ يُدْرِكْنِيْ يَوْمُكَ أَنْصُرْكَ نَصْرًا مُؤَزَّرًا ‘যদি তোমার সেই দিন আমি পাই, তবে আমি তোমাকে যথাযোগ্য সাহায্য করব’।[1]

অহি-র বিরতিকাল (فترة الوحى) :

অরাক্বা বিন নওফেলের কাছে সবকিছু শুনে নবী করীম (ছাঃ) আশা ও আশংকার দোলায় দোলায়িত হয়ে পুনরায় হেরা গুহায় ই’তেকাফে ফিরে এলেন এবং পুনরায় অহি নাযিলের অপেক্ষা করতে লাগলেন। এভাবে দশদিন অতিবাহিত করে রামাযান শেষে পূর্বের নিয়মানুযায়ী ১লা শাওয়াল সকালে ই’তেকাফ শেষ করে বাড়ী অভিমুখে রওয়ানা হলেন।

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, এমন সময় আমি আসমান থেকে একটা আওয়ায পাই। তাকিয়ে দেখি যে, সেদিনের সেই ফেরেশতা আসমান ও যমীনের মধ্যবর্তী স্থানে কুরসীর উপরে বসে আছেন। আমি ভীত বিহবল হয়ে মাটিতে পড়ে যাবার উপক্রম হই। অতঃপর দ্রুত বাড়ী ফিরে স্ত্রীকে বলি, আমাকে চাদর মুড়ি দাও, চাদর মুড়ি দাও, চাদর মুড়ি দাও’। কিন্তু না অল্পক্ষণের মধ্যেই গুরুগম্ভীর স্বরে ‘অহি’ নাযিল হ’ল-

يَآ أَيُّهَا الْمُدَّثِّرُ- قُمْ فَأَنذِرْ- وَرَبَّكَ فَكَبِّرْ- وَثِيَابَكَ فَطَهِّرْ- وَالرُّجْزَ فَاهْجُرْ-

(১) ‘হে চাদরাবৃত! (২) উঠো, মানুষকে (আল্লাহর) ভয় দেখাও, (৩) তোমার প্রভুর মাহাত্ম্য ঘোষণা কর, (৪) তোমার পোশাক পবিত্র রাখো, (৫) অপবিত্রতা পরিহার কর’(মুদ্দাছছির ৭৪/১-৫)। এরপর থেকে ‘অহি’ চালু হয়ে গেল’।[2]

২১শে রামাযানের কদর রাতে প্রথম অহি নাযিলের পর থেকে এই দশদিনের বিরতিকালকে فترة الوحى বা অহি-র বিরতিকাল বলা হয়। এটি আড়াই বা তিন বছরের জন্য ছিল না, যা প্রসিদ্ধ আছে। = (আর-রাহীক্ব পৃঃ ৬৯)।

অহি-র প্রকারভেদ

‘অহি’ (الوحى) অর্থ প্রত্যাদেশ, যা আল্লাহর পক্ষ হ’তে তাঁর নির্বাচিত বান্দার নিকটে হয়ে থাকে। হাফেয ইবনুল ক্বাইয়িম নবীদের নিকটে অহি-র সাতটি প্রকারভেদ বর্ণনা করেছেন:-

(১) সত্য স্বপ্নের মাধ্যমে। ৪০ বছর বয়সের রবীউল আউয়াল থেকে রামাযান মাস পর্যন্ত প্রথম ছয়মাস যা রাসূল (ছাঃ) প্রাপ্ত হয়েছিলেন (২) অদৃশ্য থেকে হৃদয়ে অহি-র প্রক্ষেপন, যা জিব্রীল মাঝে-মধ্যে রাসূলের উপরে করতেন (৩) মানুষের রূপ ধারণ করে জিব্রীল এসে অহী বর্ণনা করে শুনাতেন। যেমন একবার দেহিয়াতুল কালবীর রূপ ধারণ করে ছাহাবীগণের মজলিসে এসে রাসূলকে ঈমান, ইসলাম, ইহসান ও ক্বিয়ামতের আলামত সম্পর্কে প্রশ্নোত্তরের মাধ্যমে শিক্ষা দেন (৪) ঘণ্টাধ্বনির আওয়ায করে ‘অহি’ নাযিল হ’ত। এ সময় রাসূল (ছাঃ) খুব কষ্ট অনুভব করতেন। প্রচন্ড শীতের দিনেও দেহে ঘাম ঝরত। উটের পিঠে থাকলে অধিক ভারবোধে উট বসে পড়ত। রাসূলের উরুর চাপে একবার এ অবস্থায় যায়েদ বিন ছাবিতের উরুর হাড় ভেঙ্গে যাবার উপক্রম হয়েছিল (৫) জিব্রীল (আঃ) স্বরূপে এসে অহি প্রদান করতেন। এটি দু’বার ঘটেছে (৬) মে‘রাজ রজনীতে আসমানে অবস্থানকালে আল্লাহর সরাসরি অহি-র মাধ্যমে ছালাত ফরয করণ (৭) আল্লাহ স্বীয় নবীর সঙ্গে সরাসরি ফেরেশতার মাধ্যম ছাড়াই পর্দার অন্তরাল থেকে কথা বলেন। যেমন মূসা (আঃ)-এর সঙ্গে তূর পাহাড়ে কথা বলার প্রমাণ কুরআনে বর্ণিত হয়েছে এবং শেষনবীর সঙ্গে মে‘রাজ রজনীতে আরশের নিকটে কথোপকথনের প্রমাণ হাদীছে বিধৃত হয়েছে। =(আর-রাহীক্ব পৃঃ ৭০)।

শিক্ষণীয় বিষয়

১. সর্বপ্রথম নাযিলকৃত সূরা আলাক্বের প্রথম পাঁচটি আয়াতে পড়া ও লেখা এবং তার মাধ্যমে এমন জ্ঞান অর্জনের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, যা আধ্যাত্মিক ও বৈষয়িক উভয় জ্ঞানের সমন্বয় সাধন করে।

২. আলাক্ব-এর চাহিদা পূরণে গৃহীত শিক্ষা যেন মানুষকে খালেক-এর সন্ধান দেয় এবং তাঁর প্রতি ইবাদত ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ্যে উদ্বুদ্ধ করে। সে বিষয়ে ইঙ্গিত করা হয়েছে।

৩. সসীম মানবীয় জ্ঞানের সাথে অসীম এলাহী জ্ঞানের হেদায়াত যুক্ত না হওয়া পর্যন্ত মানুষ কখনোই প্রকৃত সত্য খুঁজে পাবে না- সেকথা স্পষ্টভাবেই সেখানে বলে দেওয়া হয়েছে। যেমন মানুষের নিজস্ব দৃষ্টিশক্তির সাথে চশমা, অনুবীক্ষণ বা দূরবীক্ষণ যন্ত্র যুক্ত হ’লে তার দৃষ্টিসীমা প্রসারিত হয়। বলা বাহুল্য, মানবজাতির প্রতি এটিই ছিল কুরআনের সর্বপ্রথম ইলাহী আহবান।

৪. অতঃপর দশদিন বিরতির পর সূরা মুদ্দাছছিরে নাযিল কৃত পাঁচটি আয়াতে পূর্বোক্ত অভ্রান্ত জ্ঞানের তথা তাওহীদের প্রচার ও প্রসারের গুরু দায়িত্ব ন্যস্ত করা হয়েছে এক অপূর্ব অলংকার সমৃদ্ধ ভাষায়। চাদর ঝেড়ে ফেলে উঠে দাঁড়াও! ভোগবাদী মানুষকে শয়তানের ধোঁকা থেকে বাঁচাও। সর্বত্র আল্লাহর সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা কর। শিরক ও জাহেলিয়াতের কলুষময় পোষাক ঝেড়ে-মুছে ছাফ করে ফেল’। সকল অপবিত্রতা হ’তে মুক্ত হও। অর্থাৎ মানুষের মনোজগতে ও কর্মজগতে আমূল সংস্কার সাধনের প্রতিজ্ঞা নিয়ে হে চাদরাবৃত মুহাম্মাদ! উঠে দাঁড়াও!!

৫. একই সময়ে একই দরদভরা ভাষায় সূরা মুযযাম্মিল নাযিল করে রাসূল ও ছাহাবীগণের জন্য রাত্রির ছালাত তাহাজ্জুদ আবশ্যিক করে দেওয়া হয়। কেননা পরবর্তী সমাজ বিপ্লবের গুরুদায়িত্ব পালনের জন্য মানসিক ও আধ্যাত্মিক শক্তি সম্পন্ন মানুষ তৈরী করা ছিল প্রধান কাজ। আর আধ্যাত্মিক মানস গঠনে তাহাজ্জুদের ছালাতের ভূমিকা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।

৬. দুনিয়া পূজারী অধঃপতিত জাতিকে উদ্ধারের যেপথ মুহাম্মাদ (ছাঃ) তালাশ করছিলেন, তা তিনি পেয়ে গেলেন আল্লাহর অহি-র মাধ্যমে। আর তা হ’ল এই যে, সার্বিক জীবনে অহি-র বিধান অনুসরণের মধ্যেই কেবল মানবতার পূর্ণ বিকাশ সম্ভব এবং দুনিয়ার পূজা নয়, আখেরাতে মুক্তিই হবে দুনিয়াবী জীবনের একমাত্র লক্ষ্য। অন্য কোন পথে মানবতার মুক্তি নেই।

৭. সত্যিকারের মানবদরদী ব্যক্তির জন্য তাই ইসলামের যথাযথ অনুসরণ ব্যতীত অন্য কোন পথ খোলা নেই। আর ইসলাম ব্যতীত বর্তমান পৃথিবীতে আল্লাহ প্রেরিত কোন দ্বীন বা জীবন বিধানের অস্তিত্ব নেই।

এরপর থেকে শুরু হ’ল দীর্ঘ তেইশ বছরের সংগ্রামী নবুঅতী জীবন। তবে মাক্কী জীবনের ১৩ বছর ছিল নিরবচ্ছিন্নভাবে দাওয়াতী জীবন এবং শেষ দশ বছরের মাদানী জীবন ছিল তাওহীদ ভিত্তিক সমাজ গঠনের জন্য দাওয়াত ও জিহাদের সমন্বিত জীবন।

ছালাতের নির্দেশনা

যেকোন সংস্কার আন্দোলনের জন্য সর্বাগ্রে প্রয়োজন সংস্কারকের নিজ আক্বীদার মযবুতী। আর এই মযবুতী রক্ষার জন্য চাই নিয়মিত মনোজাগতিক প্রশিক্ষণ। যা সর্বদা সংস্কারককে তার আদর্শমূলে দৃঢ়ভাবে ধরে রাখে। সেকারণ অধ্যাত্ম সাধনার প্রাথমিক সিলেবাস হিসাবে মুহাম্মাদ (ছাঃ)-কে নবুঅতের শুরু থেকেই সকাল ও সন্ধ্যায় দু’বার ছালাত আদায়ের নির্দেশনা দান করা হয়। যেমন আল্লাহ বলেন, وَسَبِّحْ بِحَمْدِ رَبِّكَ بِالْعَشِيِّ وَالْإِبْكَارِ ‘তুমি তোমার প্রভুর প্রশংসা জ্ঞাপন কর সন্ধ্যায় ও সকালে’ (মুমিন/গাফের ৪০/৫৫)।

প্রথম কুরআন নাযিলের পর জিব্রীলের মাধ্যমে তিনি ওযূ ও ছালাত আদায় শিখেন।[3] হিজরতের স্বল্পকাল পূর্বে মে‘রাজ সংঘটিত হবার আগ পর্যন্ত ফজরের দু’রাক‘আত ও মাগরিবের দু’রাক‘আত করে ছালাত আদায়ের নিয়ম জারি থাকে। অতঃপর নিয়মিতভাবে পাঁচ ওয়াক্ত ছালাত ফরয হয় মে‘রাজের রাত্রিতে। উল্লেখ্য যে, পূর্বেকার সকল নবীর সময়ে ছালাত, ছিয়াম ও যাকাত ফরয ছিল। যদিও সেসবের ধরণ ও পদ্ধতি ছিল কিছুটা পৃথক।

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ও তাঁর সাথীগণ প্রথম তিন বছর গোপনে এই ছালাত আদায় করতেন এবং লোকদেরকে গাছ, পাথর, চন্দ্র, সূর্য ইত্যাদির উপাসনা পরিত্যাগ করে আল্লাহর ইবাদত শিক্ষা দিতেন। তিনি কখনো কখনো সাথীদের নিয়ে পাহাড়ের গুহাতে গোপনে ছালাত আদায় করতেন। একদিন আবু তালিব স্বীয় পুত্র আলী ও ভাতিজা মুহাম্মাদকে এটা আদায় করতে দেখে কারণ জিজ্ঞেস করেন। সবকিছু শুনে বিষয়টির আধ্যাত্মিক গুরুত্ব উপলব্ধি করে তিনি তাদেরকে উৎসাহিত করেন। পরে يَااَيُّهَا الْمُزَّمِّلُ (হে বস্ত্রাবৃত!) বলে সূরা মুযযাম্মিল নাযিল করে আল্লাহ রাতে প্রায় সিকি অংশ তাহাজ্জুদের ছালাতে কাটিয়ে দেবার জন্য তাঁর নবী ও সাথীদের উপরে ফরয করে দেন। পরবর্তীতে মে‘রাজে পাঁচ ওয়াক্ত ছালাত ফরয হ’লে তাহাজ্জুদ নফল হয়ে যায়।

পরবর্তী অংশ পড়ুন: হযরত মুহাম্মাদ (ছাঃ) এর জীবনী পর্ব ৫ – দাওয়াতী কার্যক্রম

[1] মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/৫৮৪১ ‘ফাযায়েল’ অধ্যায়, ‘অহি-র সূচনা’ অনুচ্ছেদ; আর-রাহীক্ব পৃঃ ৬৭-৬৮।

[2] মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/৫৮৪৩।

[3] আহমাদ, দারাকুৎনী, মিশকাত হা/৩৬৬ ‘পবিত্রতা’ অধ্যায়, ৩ অনুচ্ছেদ।

]]>

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button

Adblock Detected

Please consider supporting us by disabling your ad blocker